ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০২৪, ১১ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
রমজানে মাধ্যমিক স্কুল খোলা থাকবে ১৫ দিন, প্রাথমিক স্কুল ১০ দিন খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে টেকনাফ সীমান্তের হোয়াইক্যং এলাকা দিয়ে আজ অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মিয়ানমারের সেনা সাদ সাহেব রুজু করার পর দেওবন্দের মাসআলা খতম হয়ে গেছে : মাওলানা আরশাদ মাদানী চলছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিনের বয়ান পুলিশ সদস্যসহ বিশ্ব ইজতেমায় ৭ জনের মৃত্যু বর্তমান সরকারের সঙ্গে সব দেশ কাজ করতে চায়: পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়পুরহাটে স্কুলছাত্র হত্যায় ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্প পর্যালোচনায় কমিটি গঠন করলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়

করোনাকালে অনলাইন ক্লাসের হরেক তরিকা

  • নিউজ ডেস্ক
  • প্রকাশিত : ১০:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জুলাই ২০২০
  • ১২৮০ পঠিত
  • বেসকারি স্কুলের শিক্ষকেরা বলছেন, ছেলেমেয়েদের পড়ার চর্চা রাখাটাই মূল উদ্দেশ্য। বেশ কয়েকজন অভিভাবক অবশ্য বলেছেন, কিছু স্কুল বেতন আদায়ের তাগিদে পর্যাপ্ত সুবিধা ছাড়া ক্লাস করাচ্ছে।
  • পাবলিক পরীক্ষা সামনে রেখে জুম অ্যাপে কেবল পঞ্চম, অষ্টম, নবম, দশম ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাস হচ্ছে। অসচ্ছল পরিবারের মেয়েরা বাদে বেশির ভাগ ছাত্রীই যোগ দিচ্ছে।—বাবলী পুরকায়স্থ, প্রধান শিক্ষক, সিলেট সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ
  • মাউশি সুবিধাসম্পন্ন স্কুলকে অবিলম্বে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চালু করতে বলুক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যায় থাকা এলাকাগুলো চিহ্নিত করে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে ব্যবস্থা নিতে বলুক। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন নিজেদের বিশেষ তহবিল ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক।—নজরুল ইসলাম খান, সাবেক শিক্ষাসচিব

মতিঝিলে বড় রাস্তার পাশেই স্কুলটি। সামনের ফুটপাতে অভিভাবকদের জটলা নেই। বড় ফটকের ছোট দরজাটি খোলা। দারোয়ানকে পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকি। মাঠ খাঁ খাঁ করছে, চারটি বহুতল ভবনে সারি সারি বন্ধ ক্লাসঘর।

করোনা বদলে দিয়েছে মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চিরচেনা পরিবেশ। ৫ জুলাই রোববার দুপুরে স্কুলটির ত্রিসীমানায় একজন শিক্ষার্থীকেও দেখা গেল না। অফিসের দালানে কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মচারী শুধু দাপ্তরিক কাজ করছিলেন।

অভিভাবকেরা কেউ কেউ অনলাইন ডেটার খরচের কথা তুললেন। অনেকেই বললেন, পুরো বেতন দেওয়ার যুক্তি পাচ্ছেন না। করোনাকালে সামর্থ্যেও কুলাচ্ছে না।

ঢাকার ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল স্কলাসটিকা করোনা বন্ধের প্রথম দিকে জুম অ্যাপ ব্যবহার করে ক্লাস নিচ্ছিল। এ মাধ্যমে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় জুলাইয়ে। নতুন শিক্ষাবর্ষে স্কুলটি ‘গুগল ক্লাসরুম’, ‘গুগল মিট’ অ্যাপে পড়ানো শুরু করেছে।

গত ১৭ মার্চ থেকে আজ চার মাস হলো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে করোনার বন্ধ চলছে। প্রথম আলো খুঁজে পেতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে শহরাঞ্চলে অন্তত ৩০টির বেশি মাধ্যমিক স্কুলে এ সময় অনলাইন ক্লাস নেওয়ার তথ্য পেয়েছে। মূলত ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলে, ইউটিউব ব্যবহার করে এবং জুম, গুগল ক্লাসরুম ও গুগল মিটের সাহায্যে ক্লাসগুলো হচ্ছে। কয়েকটি স্কুল অভিভাবকদের সাহায্যে পরীক্ষাও নিয়েছে।

প্রায় সবগুলো স্কুলে প্রাথমিক ও ছোট পরিসরে উচ্চমাধ্যমিক স্তরও আছে। বেশির ভাগই বেসরকারি স্কুল, মূলত তারাই নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছে। শিক্ষকেরা বলছেন, ছেলেমেয়েদের পড়ার চর্চা রাখাটাই মূল উদ্দেশ্য। বেশ কয়েকজন অভিভাবক অবশ্য বলেছেন, কিছু স্কুল বেতন আদায়ের তাগিদে পর্যাপ্ত সুবিধা ছাড়া ক্লাস করাচ্ছে।

সরকারের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদপ্তরের (মাউশি) কাছে অনলাইনে ক্লাস চালানো স্কুলের সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। প্রথম আলো এসব স্কুলের শিক্ষকদের দুটি সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা বলেছেন, ঢাকা ও বিভিন্ন শহরের প্রায় সবগুলো পরিচিত বেসরকারি স্কুল অনলাইনে কোনো না কোনো তরিকায় ক্লাস নিচ্ছে।

এই শিক্ষকেরা বলেছেন, সংসদ টিভিতে প্রচারিত রেকর্ড করা ক্লাসগুলো কাজে আসছে না। শহরের কিছু সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও তাই অনলাইনে ক্লাস চালু করেছে। দু-একটি জেলা কর্তৃপক্ষের সার্বিক উদ্যোগ আছে। তবে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চলের স্কুল।

দেশে মাধ্যমিকে পড়ছে ১ কোটি ৩৪ লাখের মতো ছেলেমেয়ে। স্কুল আছে ২১ হাজার। প্রাথমিক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থী প্রায় পৌনে দুই কোটি, সিংহভাগই অবশ্য সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ে। মোট কলেজ আছে সাড়ে চার হাজারের মতো, শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪৪ লাখ।

সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, করোনার ছুটি চলবে আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্তও তা গড়াতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, প্রয়োজনে ডিসেম্বরে শেষ না করে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাবর্ষটি টানা হতে পারে।

যা বোঝা যাচ্ছে, করোনাকাল লম্বা হলে এ বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামনাসামনি ক্লাস না-ও হতে পারে। সুতরাং অনলাইন ছাড়া গতি নেই। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থী এতে সড়গড় না। ল্যাপটপ তো দূরের কথা, অনেকের বাড়িতে স্মার্টফোনও নেই। ইন্টারনেট খরচ জোগানোর সামর্থ্য সবার নেই। শহর-গ্রামনির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো আমলে নিয়ে সুরাহা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

ফেসবুক ও ইউটিউব
ঢাকার তিন এলাকায় আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের তিনটি শাখায় নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের মোট প্রায় ২৬ হাজার ছেলেমেয়ে পড়ে। এ স্কুলে বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি আছে ইংরেজি ভার্সন। সেখানে শিক্ষাক্রম এক, শেখানোর মাধ্যমটি ইংরেজি।

৫ জুলাই মূল শাখা মতিঝিলের স্কুলটিতে তাঁর অফিসঘরে করোনা–দূরত্বে বসে কথা হলো সহকারী প্রধান শিক্ষক (ইংরেজি ভার্সন) মনিরুল হাসানের সঙ্গে। তিনি বললেন, গত ১৮ এপ্রিল থেকে স্কুলের নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকদের এর সদস্য করা হয়। প্রথম তিন দিনেই সদস্য দাঁড়ায় ১৬ হাজার। শিক্ষকেরা বাড়ি থেকে মোবাইল, কম্পিউটার বা ল্যাপটপের মাধ্যমে ফেসবুক লাইভে ক্লাস করাতে থাকেন।

স্কুলের তিন শাখার জন্য একটিমাত্র গ্রুপে বেশি ক্লাস ধরানো যাচ্ছিল না। পরে প্রতিটি শাখা ও প্রতিটি ভার্সনের জন্য আলাদা গ্রুপ খোলা হয়। এখন ফেসবুক গ্রুপ আছে ছয়টি। প্রাথমিক থেকে নিয়ে প্রতি শ্রেণিতে সপ্তাহে ছয় দিন দিনে তিনটি করে ৩০ মিনিটের ক্লাস হচ্ছে। ক্লাসগুলো নিচ্ছেন প্রায় ৩০০ জন শিক্ষক।

স্কুলটিতে মোট শিক্ষক প্রায় ৭০০ জন। তাঁদের ১১৬ জন এমপিওভুক্ত, যাঁদের মূল বেতন দেয় সরকার। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়াসহ বাদবাকি সব শিক্ষকের বেতন-ভাতা দেয় স্কুল। আয়ের মূল উৎস শিক্ষার্থীদের বেতন।

স্কুলের বেতন ১ হাজার ৩০০ টাকা আর কলেজের ২ হাজার ১০০ টাকা। করোনার কালে স্কুলের তাগাদায় অর্ধেকের মতো অভিভাবক ছেলেমেয়ের জুন নাগাদ বেতন চুকিয়েছেন। স্কুল এখন আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেতন চাইছে। অনেক অভিভাবক বলেছেন, করোনাকালে আয় কমায় এটা বড় চাপ। অনেকের একাধিক সন্তান স্কুলটিতে পড়ে।

ফেরা যাক ফেসবুক লাইভ ক্লাসে। ৯ জুলাই সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞানের একটি ক্লাসে নিজেই ঢুকে পড়েছিলাম। শিক্ষক রুবায়েতুল আলম বাসা থেকে বোর্ডে লিখে লিখে পড়াচ্ছিলেন। লাইভ শেষে গ্রুপে ক্লাসের ভিডিওটি দিয়ে রাখলেন।

আতাউর রহমান দশম শ্রেণির বাংলার ক্লাস নেন। বললেন, ক্লাসে শিক্ষার্থীরা সরাসরি প্রশ্ন করতে পারলে ভালো হতো। অবশ্য ইংরেজি ভার্সনের একজন শিক্ষক বললেন, শিক্ষার্থীরা ইনবক্সে প্রশ্ন করলে পরে জবাব দেওয়া যায়।

সহকারী প্রধান শিক্ষক মনিরুল হাসান বলেছিলেন, গড়ে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী এই ক্লাস করছেন। তবে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে দুই রকম চিত্র পাই। মালিবাগের বাসিন্দা নিয়াজ মাখদুম নবম শ্রেণিতে পড়ে, নিয়মিত ক্লাস করে। সে বলল, ক্লাসগুলো ভালো হয়। তার মা নাজিয়া ইসলাম বললেন, ক্লাসের জন্য বাসায় ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিয়েছেন।

গোপীবাগের একজন অভিভাবক পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া মেয়ের জন্য গোড়াতে মোবাইলে ইন্টারনেট ডেটার ৪০০ টাকার প্যাকেজ কিনেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর মেয়ে ক্লাস করা ছেড়েছে, তাঁরও আয়-রোজগারে টান পড়েছে। আরেক মা বললেন, দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে গোড়ায় দু–চার দিন ক্লাস করেছিল। কিন্তু এখন আর ‘পড়ে-টড়ে না। সামনাসামনিই ঠিকমতো পড়া হয় না, অনলাইনে আর কি পড়া হবে?’

ইতিমধ্যে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার সময় পেরিয়েছে, কিন্তু পরীক্ষা হয়নি। আইডিয়ালের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম প্রথম আলোকে বললেন, সরকার সিদ্ধান্ত দিলে পরীক্ষা হবে। প্রথম আলো অন্তত আটটি স্কুলে ফেসবুক লাইভে পড়ালেখার নজির পেয়েছে। সুবিধা বা সমস্যাগুলো একই রকম।

ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে প্রায় ১৫ হাজার মেয়ে। শিক্ষকেরা গত ৭ এপ্রিল থেকে ক্লাসগুলো রেকর্ড করে স্কুলের নামে খোলা ইউটিউব চ্যানেলে শেয়ার করছেন। অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া বললেন, প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০টি ক্লাসের ভিডিও ওঠে। এযাবৎ উঠেছে এক হাজারের মতো। নির্দিষ্ট শিক্ষকেরা শ্রেণি ধরে ক্লাস সমন্বয় করেন।

তবে এই ব্যবস্থায় শুধু ডাউনলোড করে ক্লাস দেখা যায়। অধ্যক্ষ ফওজিয়া বললেন, ১২ জুলাই থেকে ‘নূন বাতায়ন’ নামের গ্রুপে ফেসবুক লাইভে ক্লাস শুরু হয়েছে। এ ছাড়া পাবলিক পরীক্ষার বিবেচনায় পঞ্চম, অষ্টম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে জুমে ক্লাস চালু হয়েছে। তিনি বললেন, দীর্ঘ করোনা বন্ধে এ ছাড়া উপায় নেই।

রাজধানীর ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলও ফেসবুক পেজে ক্লাস করাচ্ছে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে একটি ‘স্মার্ট ক্লাসরুম’ তৈরি করা হয়েছে। এখান থেকে শিক্ষকেরা ফেসবুক লাইভে ক্লাস করাচ্ছেন। অনেক শিক্ষক বাড়ি থেকেও এই ক্লাস নিচ্ছেন। শিক্ষক এ কে এম মাসুদ রানা বললেন, তাঁরা গুগুল ক্লাসরুমে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবছেন।

মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ স্থানীয় সাংসদের মালিকানাধীন একটি বেসরকারি টিভির মাধ্যমে প্রতিদিন তিনটি ক্লাস সম্প্রচার করে। পরে ভিডিওগুলো ফেসবুকে তুলে দেয়। ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে জুমে ক্লাস শুরু হয়েছে।

 

জুম আর গুগলের যত কেরামতি
১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কলাসটিকা নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর একটি। রাজধানীতে এ স্কুলের পাঁচটি ক্যাম্পাসে মোট প্রায় ছয় হাজার ছেলেমেয়ে পড়ে। ৭ ও ১০ জুলাই মুঠোফোনে কথা বলি উত্তরা সিনিয়র ক্যাম্পাসের অধ্যক্ষ ফারাহ সোফিয়া আহমেদের সঙ্গে।

অধ্যক্ষ বললেন, গত মে পর্যন্ত জুমের মাধ্যমে বিদায়ী সেশনের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। কোনো পরীক্ষা হয়নি। গত তিনটি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ছেলেমেয়েরা ওপরের ক্লাসে উঠেছে। এক মাস প্রস্তুতির পর ৮ জুলাই থেকে গুগল ক্লাসরুম ও গুগল মিট অ্যাপে নতুন বছরের ক্লাস শুরু হয়েছে। পরীক্ষাও হবে। ক্লাসের সময় বরাবরই ৪০ মিনিট। ব্যবহারিক ক্লাসের ভিডিও দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকার একটি সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক ফেসবুকে ৮ জুলাই কম্পিউটারের সামনে বসা মেয়ের ছবি দিয়ে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ প্রার্থনা করেছেন। ছোট মেয়েটি এবারই স্কলাসটিকার মিরপুর জুনিয়র ক্যাম্পাসে কেজি ওয়ানে ভর্তি হয়েছে।

৯ জুলাই মুঠোফোনে এই মা বললেন, ‘প্রথম দিকে তো, এখন মজাই পাচ্ছে। তবে ক্লাসের মতো পড়াশোনা তো আর সম্ভব না।’ তাঁর ছেলে মিরপুরের ডারল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সে-ও নিয়মিত জুমে ক্লাস করছে। প্রথম দিকে ছেলের কিছু অসুবিধা হতো, এখন সব ঠিকঠাক।

গুগল আর জুমের সুবিধা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা সরাসরি অংশ নিতে পারে। প্রথম আলো ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অন্তত সাতটি স্কুলে এ ধরনের অ্যাপ ব্যহার করে নিয়মিত ক্লাস হওয়ার তথ্য পেয়েছে। ঢাকায় বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্লাস হচ্ছে গুগল মিটে। জুমে নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছে উদয়ন উচ্চবিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যমের একাডেমিয়াসহ কয়েকটি স্কুল।

হোয়াটসঅ্যাপে পরীক্ষা ও অন্যান্য
ঢাকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা নিয়েছে অনলাইনে। বেসরকারি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভার্সনও আছে। শরিফুল ইসলাম ইংরেজি পড়ান। ৭ জুলাই মুঠোফোনে তিনি বললেন, করোনা বন্ধের গোড়ায় তাঁরা হোয়াটসঅ্যাপে শ্রেণিভিত্তিক আলাদা গ্রুপ খুলে নোটসহ বাড়ির কাজ দেওয়া শুরু করেন। গত জুনের মাঝামাঝি পরীক্ষা নিয়েছেন।

এই শিক্ষক বললেন, প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। একটি করে বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে ৫০ নম্বরে, মূলত সংক্ষিপ্ত প্রশ্নে। বাসায় অভিভাবকের পাহারায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত পরীক্ষা চলেছে। শিক্ষকেরা দুই মিনিট আগে গ্রুপে প্রশ্নপত্র পাঠাতেন। সময় শেষ হওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে উত্তরপত্রের ছবি তুলে অভিভাবকেরা গ্রুপে পাঠাতেন। এখন খাতা দেখা চলছে।

ইতিমধ্যে ১ জুলাই পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত জুমে ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রতিদিন তিনটি করে ৪০ মিনিটের ক্লাস হচ্ছে। শিক্ষকেরা ক্লাস শুরুর পাঁচ মিনিট আগে শিক্ষার্থীদের কাছে লিংক পাঠিয়ে দেন। সেটা দিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ঢোকেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক এ কে এম মাহফুজুর রহমানের মেয়ে বাংলা মাধ্যমে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তাঁর মতে, উদ্যোগটি বেশ ভালো।

রাজধানীর অরণি বিদ্যালয় গত এপ্রিল থেকে প্রতি শ্রেণির জন্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে বাড়ির কাজ দিচ্ছে। এখানেই প্রশ্ন পাঠিয়ে অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক নিনা ভূঁইয়া বললেন, সামনে গুগল মিট বা জুমে ক্লাস হবে। সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ রেকর্ড করা ক্লাস অভিভাবকদের হোয়াটসঅ্যাপ আইডিতে পাঠাচ্ছে।

সরকারি স্কুলের নানা রকম
সরকারিভাবে স্কুল পর্যায়ে বিকল্প বলতে আছে সংসদ টিভিতে প্রচারিত ক্লাস। অনলাইনে ক্লাসের কেন্দ্রীয় কোনো সিদ্ধান্ত নেই, তবে বড় স্কুলগুলোর নিজস্ব উদ্যোগ আছে। মাউশির মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক বললেন, অনলাইনে ক্লাসকে তাঁরা উৎসাহিত করছেন।

ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল মার্চের শেষ দিকে ফেসবুক লাইভে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির কিছু কিছু ক্লাস নিতে শুরু করে। কিছুদিন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও ক্লাস চলে। ১৭ এপ্রিল থেকে নিয়মিত চলছে জুমে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া। তিনি বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি। বললেন, ঢাকার মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় ও তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট মহানগরে কয়েকটি উদ্যোগ আছে।

সিলেট সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ জুমে ক্লাস নিচ্ছে। তবে প্রধান শিক্ষক বাবলী পুরকায়স্থ মুঠোফোনে বললেন, পাবলিক পরীক্ষা সামনে রেখে কেবল পঞ্চম, অষ্টম, নবম, দশম ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাস হচ্ছে। অসচ্ছল পরিবারের মেয়েরা বাদে বেশির ভাগ ছাত্রীই যোগ দিচ্ছে।

খুলনা জেলা প্রশাসন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠের ভিডিও তৈরি করেছে। সেগুলো ইউটিউব এবং ফেসবুকে যাচ্ছে। তবে সরকারি বা বেসরকারি, উদ্যোগগুলো বেশির ভাগই যে যার মতো করে করা।

গুছিয়ে সুশৃঙ্খল একটি পদ্ধতি কি দাঁড় করানো সম্ভব? সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খানের মতে, অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা দুটোই নেওয়া সম্ভব। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখাটা বড় কথা। সুবিধাসম্পন্ন স্কুলকে মাউশি অবিলম্বে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চালু করতে বলুক। অন্যগুলো ইউটিউবে চ্যানেল খুলে ক্লাসের ভিডিও রাখবে।

সাবেক এই শিক্ষাসচিব ১০ জুলাই মুঠোফোনে বললেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যায় থাকা এলাকাগুলো চিহ্নিত করে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে ব্যবস্থা নিতে বলুক। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন নিজেদের বিশেষ তহবিল ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

Tag :
জনপ্রিয়

রমজানে মাধ্যমিক স্কুল খোলা থাকবে ১৫ দিন, প্রাথমিক স্কুল ১০ দিন

করোনাকালে অনলাইন ক্লাসের হরেক তরিকা

প্রকাশিত : ১০:৫১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জুলাই ২০২০
  • বেসকারি স্কুলের শিক্ষকেরা বলছেন, ছেলেমেয়েদের পড়ার চর্চা রাখাটাই মূল উদ্দেশ্য। বেশ কয়েকজন অভিভাবক অবশ্য বলেছেন, কিছু স্কুল বেতন আদায়ের তাগিদে পর্যাপ্ত সুবিধা ছাড়া ক্লাস করাচ্ছে।
  • পাবলিক পরীক্ষা সামনে রেখে জুম অ্যাপে কেবল পঞ্চম, অষ্টম, নবম, দশম ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাস হচ্ছে। অসচ্ছল পরিবারের মেয়েরা বাদে বেশির ভাগ ছাত্রীই যোগ দিচ্ছে।—বাবলী পুরকায়স্থ, প্রধান শিক্ষক, সিলেট সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ
  • মাউশি সুবিধাসম্পন্ন স্কুলকে অবিলম্বে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চালু করতে বলুক। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যায় থাকা এলাকাগুলো চিহ্নিত করে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে ব্যবস্থা নিতে বলুক। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন নিজেদের বিশেষ তহবিল ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিক।—নজরুল ইসলাম খান, সাবেক শিক্ষাসচিব

মতিঝিলে বড় রাস্তার পাশেই স্কুলটি। সামনের ফুটপাতে অভিভাবকদের জটলা নেই। বড় ফটকের ছোট দরজাটি খোলা। দারোয়ানকে পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকি। মাঠ খাঁ খাঁ করছে, চারটি বহুতল ভবনে সারি সারি বন্ধ ক্লাসঘর।

করোনা বদলে দিয়েছে মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চিরচেনা পরিবেশ। ৫ জুলাই রোববার দুপুরে স্কুলটির ত্রিসীমানায় একজন শিক্ষার্থীকেও দেখা গেল না। অফিসের দালানে কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মচারী শুধু দাপ্তরিক কাজ করছিলেন।

অভিভাবকেরা কেউ কেউ অনলাইন ডেটার খরচের কথা তুললেন। অনেকেই বললেন, পুরো বেতন দেওয়ার যুক্তি পাচ্ছেন না। করোনাকালে সামর্থ্যেও কুলাচ্ছে না।

ঢাকার ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল স্কলাসটিকা করোনা বন্ধের প্রথম দিকে জুম অ্যাপ ব্যবহার করে ক্লাস নিচ্ছিল। এ মাধ্যমে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় জুলাইয়ে। নতুন শিক্ষাবর্ষে স্কুলটি ‘গুগল ক্লাসরুম’, ‘গুগল মিট’ অ্যাপে পড়ানো শুরু করেছে।

গত ১৭ মার্চ থেকে আজ চার মাস হলো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে করোনার বন্ধ চলছে। প্রথম আলো খুঁজে পেতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে শহরাঞ্চলে অন্তত ৩০টির বেশি মাধ্যমিক স্কুলে এ সময় অনলাইন ক্লাস নেওয়ার তথ্য পেয়েছে। মূলত ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলে, ইউটিউব ব্যবহার করে এবং জুম, গুগল ক্লাসরুম ও গুগল মিটের সাহায্যে ক্লাসগুলো হচ্ছে। কয়েকটি স্কুল অভিভাবকদের সাহায্যে পরীক্ষাও নিয়েছে।

প্রায় সবগুলো স্কুলে প্রাথমিক ও ছোট পরিসরে উচ্চমাধ্যমিক স্তরও আছে। বেশির ভাগই বেসরকারি স্কুল, মূলত তারাই নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছে। শিক্ষকেরা বলছেন, ছেলেমেয়েদের পড়ার চর্চা রাখাটাই মূল উদ্দেশ্য। বেশ কয়েকজন অভিভাবক অবশ্য বলেছেন, কিছু স্কুল বেতন আদায়ের তাগিদে পর্যাপ্ত সুবিধা ছাড়া ক্লাস করাচ্ছে।

সরকারের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদপ্তরের (মাউশি) কাছে অনলাইনে ক্লাস চালানো স্কুলের সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। প্রথম আলো এসব স্কুলের শিক্ষকদের দুটি সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা বলেছেন, ঢাকা ও বিভিন্ন শহরের প্রায় সবগুলো পরিচিত বেসরকারি স্কুল অনলাইনে কোনো না কোনো তরিকায় ক্লাস নিচ্ছে।

এই শিক্ষকেরা বলেছেন, সংসদ টিভিতে প্রচারিত রেকর্ড করা ক্লাসগুলো কাজে আসছে না। শহরের কিছু সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও তাই অনলাইনে ক্লাস চালু করেছে। দু-একটি জেলা কর্তৃপক্ষের সার্বিক উদ্যোগ আছে। তবে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চলের স্কুল।

দেশে মাধ্যমিকে পড়ছে ১ কোটি ৩৪ লাখের মতো ছেলেমেয়ে। স্কুল আছে ২১ হাজার। প্রাথমিক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থী প্রায় পৌনে দুই কোটি, সিংহভাগই অবশ্য সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ে। মোট কলেজ আছে সাড়ে চার হাজারের মতো, শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪৪ লাখ।

সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, করোনার ছুটি চলবে আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্তও তা গড়াতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, প্রয়োজনে ডিসেম্বরে শেষ না করে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাবর্ষটি টানা হতে পারে।

যা বোঝা যাচ্ছে, করোনাকাল লম্বা হলে এ বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সামনাসামনি ক্লাস না-ও হতে পারে। সুতরাং অনলাইন ছাড়া গতি নেই। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থী এতে সড়গড় না। ল্যাপটপ তো দূরের কথা, অনেকের বাড়িতে স্মার্টফোনও নেই। ইন্টারনেট খরচ জোগানোর সামর্থ্য সবার নেই। শহর-গ্রামনির্বিশেষে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো আমলে নিয়ে সুরাহা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

ফেসবুক ও ইউটিউব
ঢাকার তিন এলাকায় আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের তিনটি শাখায় নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের মোট প্রায় ২৬ হাজার ছেলেমেয়ে পড়ে। এ স্কুলে বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি আছে ইংরেজি ভার্সন। সেখানে শিক্ষাক্রম এক, শেখানোর মাধ্যমটি ইংরেজি।

৫ জুলাই মূল শাখা মতিঝিলের স্কুলটিতে তাঁর অফিসঘরে করোনা–দূরত্বে বসে কথা হলো সহকারী প্রধান শিক্ষক (ইংরেজি ভার্সন) মনিরুল হাসানের সঙ্গে। তিনি বললেন, গত ১৮ এপ্রিল থেকে স্কুলের নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকদের এর সদস্য করা হয়। প্রথম তিন দিনেই সদস্য দাঁড়ায় ১৬ হাজার। শিক্ষকেরা বাড়ি থেকে মোবাইল, কম্পিউটার বা ল্যাপটপের মাধ্যমে ফেসবুক লাইভে ক্লাস করাতে থাকেন।

স্কুলের তিন শাখার জন্য একটিমাত্র গ্রুপে বেশি ক্লাস ধরানো যাচ্ছিল না। পরে প্রতিটি শাখা ও প্রতিটি ভার্সনের জন্য আলাদা গ্রুপ খোলা হয়। এখন ফেসবুক গ্রুপ আছে ছয়টি। প্রাথমিক থেকে নিয়ে প্রতি শ্রেণিতে সপ্তাহে ছয় দিন দিনে তিনটি করে ৩০ মিনিটের ক্লাস হচ্ছে। ক্লাসগুলো নিচ্ছেন প্রায় ৩০০ জন শিক্ষক।

স্কুলটিতে মোট শিক্ষক প্রায় ৭০০ জন। তাঁদের ১১৬ জন এমপিওভুক্ত, যাঁদের মূল বেতন দেয় সরকার। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়াসহ বাদবাকি সব শিক্ষকের বেতন-ভাতা দেয় স্কুল। আয়ের মূল উৎস শিক্ষার্থীদের বেতন।

স্কুলের বেতন ১ হাজার ৩০০ টাকা আর কলেজের ২ হাজার ১০০ টাকা। করোনার কালে স্কুলের তাগাদায় অর্ধেকের মতো অভিভাবক ছেলেমেয়ের জুন নাগাদ বেতন চুকিয়েছেন। স্কুল এখন আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেতন চাইছে। অনেক অভিভাবক বলেছেন, করোনাকালে আয় কমায় এটা বড় চাপ। অনেকের একাধিক সন্তান স্কুলটিতে পড়ে।

ফেরা যাক ফেসবুক লাইভ ক্লাসে। ৯ জুলাই সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞানের একটি ক্লাসে নিজেই ঢুকে পড়েছিলাম। শিক্ষক রুবায়েতুল আলম বাসা থেকে বোর্ডে লিখে লিখে পড়াচ্ছিলেন। লাইভ শেষে গ্রুপে ক্লাসের ভিডিওটি দিয়ে রাখলেন।

আতাউর রহমান দশম শ্রেণির বাংলার ক্লাস নেন। বললেন, ক্লাসে শিক্ষার্থীরা সরাসরি প্রশ্ন করতে পারলে ভালো হতো। অবশ্য ইংরেজি ভার্সনের একজন শিক্ষক বললেন, শিক্ষার্থীরা ইনবক্সে প্রশ্ন করলে পরে জবাব দেওয়া যায়।

সহকারী প্রধান শিক্ষক মনিরুল হাসান বলেছিলেন, গড়ে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী এই ক্লাস করছেন। তবে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আর অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে দুই রকম চিত্র পাই। মালিবাগের বাসিন্দা নিয়াজ মাখদুম নবম শ্রেণিতে পড়ে, নিয়মিত ক্লাস করে। সে বলল, ক্লাসগুলো ভালো হয়। তার মা নাজিয়া ইসলাম বললেন, ক্লাসের জন্য বাসায় ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিয়েছেন।

গোপীবাগের একজন অভিভাবক পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া মেয়ের জন্য গোড়াতে মোবাইলে ইন্টারনেট ডেটার ৪০০ টাকার প্যাকেজ কিনেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর মেয়ে ক্লাস করা ছেড়েছে, তাঁরও আয়-রোজগারে টান পড়েছে। আরেক মা বললেন, দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে গোড়ায় দু–চার দিন ক্লাস করেছিল। কিন্তু এখন আর ‘পড়ে-টড়ে না। সামনাসামনিই ঠিকমতো পড়া হয় না, অনলাইনে আর কি পড়া হবে?’

ইতিমধ্যে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার সময় পেরিয়েছে, কিন্তু পরীক্ষা হয়নি। আইডিয়ালের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম প্রথম আলোকে বললেন, সরকার সিদ্ধান্ত দিলে পরীক্ষা হবে। প্রথম আলো অন্তত আটটি স্কুলে ফেসবুক লাইভে পড়ালেখার নজির পেয়েছে। সুবিধা বা সমস্যাগুলো একই রকম।

ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে প্রায় ১৫ হাজার মেয়ে। শিক্ষকেরা গত ৭ এপ্রিল থেকে ক্লাসগুলো রেকর্ড করে স্কুলের নামে খোলা ইউটিউব চ্যানেলে শেয়ার করছেন। অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া বললেন, প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০টি ক্লাসের ভিডিও ওঠে। এযাবৎ উঠেছে এক হাজারের মতো। নির্দিষ্ট শিক্ষকেরা শ্রেণি ধরে ক্লাস সমন্বয় করেন।

তবে এই ব্যবস্থায় শুধু ডাউনলোড করে ক্লাস দেখা যায়। অধ্যক্ষ ফওজিয়া বললেন, ১২ জুলাই থেকে ‘নূন বাতায়ন’ নামের গ্রুপে ফেসবুক লাইভে ক্লাস শুরু হয়েছে। এ ছাড়া পাবলিক পরীক্ষার বিবেচনায় পঞ্চম, অষ্টম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিতে জুমে ক্লাস চালু হয়েছে। তিনি বললেন, দীর্ঘ করোনা বন্ধে এ ছাড়া উপায় নেই।

রাজধানীর ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলও ফেসবুক পেজে ক্লাস করাচ্ছে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে একটি ‘স্মার্ট ক্লাসরুম’ তৈরি করা হয়েছে। এখান থেকে শিক্ষকেরা ফেসবুক লাইভে ক্লাস করাচ্ছেন। অনেক শিক্ষক বাড়ি থেকেও এই ক্লাস নিচ্ছেন। শিক্ষক এ কে এম মাসুদ রানা বললেন, তাঁরা গুগুল ক্লাসরুমে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবছেন।

মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ স্থানীয় সাংসদের মালিকানাধীন একটি বেসরকারি টিভির মাধ্যমে প্রতিদিন তিনটি ক্লাস সম্প্রচার করে। পরে ভিডিওগুলো ফেসবুকে তুলে দেয়। ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে জুমে ক্লাস শুরু হয়েছে।

 

জুম আর গুগলের যত কেরামতি
১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কলাসটিকা নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর একটি। রাজধানীতে এ স্কুলের পাঁচটি ক্যাম্পাসে মোট প্রায় ছয় হাজার ছেলেমেয়ে পড়ে। ৭ ও ১০ জুলাই মুঠোফোনে কথা বলি উত্তরা সিনিয়র ক্যাম্পাসের অধ্যক্ষ ফারাহ সোফিয়া আহমেদের সঙ্গে।

অধ্যক্ষ বললেন, গত মে পর্যন্ত জুমের মাধ্যমে বিদায়ী সেশনের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। কোনো পরীক্ষা হয়নি। গত তিনটি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ছেলেমেয়েরা ওপরের ক্লাসে উঠেছে। এক মাস প্রস্তুতির পর ৮ জুলাই থেকে গুগল ক্লাসরুম ও গুগল মিট অ্যাপে নতুন বছরের ক্লাস শুরু হয়েছে। পরীক্ষাও হবে। ক্লাসের সময় বরাবরই ৪০ মিনিট। ব্যবহারিক ক্লাসের ভিডিও দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকার একটি সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক ফেসবুকে ৮ জুলাই কম্পিউটারের সামনে বসা মেয়ের ছবি দিয়ে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ প্রার্থনা করেছেন। ছোট মেয়েটি এবারই স্কলাসটিকার মিরপুর জুনিয়র ক্যাম্পাসে কেজি ওয়ানে ভর্তি হয়েছে।

৯ জুলাই মুঠোফোনে এই মা বললেন, ‘প্রথম দিকে তো, এখন মজাই পাচ্ছে। তবে ক্লাসের মতো পড়াশোনা তো আর সম্ভব না।’ তাঁর ছেলে মিরপুরের ডারল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সে-ও নিয়মিত জুমে ক্লাস করছে। প্রথম দিকে ছেলের কিছু অসুবিধা হতো, এখন সব ঠিকঠাক।

গুগল আর জুমের সুবিধা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা সরাসরি অংশ নিতে পারে। প্রথম আলো ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অন্তত সাতটি স্কুলে এ ধরনের অ্যাপ ব্যহার করে নিয়মিত ক্লাস হওয়ার তথ্য পেয়েছে। ঢাকায় বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্লাস হচ্ছে গুগল মিটে। জুমে নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছে উদয়ন উচ্চবিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যমের একাডেমিয়াসহ কয়েকটি স্কুল।

হোয়াটসঅ্যাপে পরীক্ষা ও অন্যান্য
ঢাকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা নিয়েছে অনলাইনে। বেসরকারি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভার্সনও আছে। শরিফুল ইসলাম ইংরেজি পড়ান। ৭ জুলাই মুঠোফোনে তিনি বললেন, করোনা বন্ধের গোড়ায় তাঁরা হোয়াটসঅ্যাপে শ্রেণিভিত্তিক আলাদা গ্রুপ খুলে নোটসহ বাড়ির কাজ দেওয়া শুরু করেন। গত জুনের মাঝামাঝি পরীক্ষা নিয়েছেন।

এই শিক্ষক বললেন, প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। একটি করে বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে ৫০ নম্বরে, মূলত সংক্ষিপ্ত প্রশ্নে। বাসায় অভিভাবকের পাহারায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত পরীক্ষা চলেছে। শিক্ষকেরা দুই মিনিট আগে গ্রুপে প্রশ্নপত্র পাঠাতেন। সময় শেষ হওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে উত্তরপত্রের ছবি তুলে অভিভাবকেরা গ্রুপে পাঠাতেন। এখন খাতা দেখা চলছে।

ইতিমধ্যে ১ জুলাই পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত জুমে ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রতিদিন তিনটি করে ৪০ মিনিটের ক্লাস হচ্ছে। শিক্ষকেরা ক্লাস শুরুর পাঁচ মিনিট আগে শিক্ষার্থীদের কাছে লিংক পাঠিয়ে দেন। সেটা দিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ঢোকেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক এ কে এম মাহফুজুর রহমানের মেয়ে বাংলা মাধ্যমে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তাঁর মতে, উদ্যোগটি বেশ ভালো।

রাজধানীর অরণি বিদ্যালয় গত এপ্রিল থেকে প্রতি শ্রেণির জন্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে বাড়ির কাজ দিচ্ছে। এখানেই প্রশ্ন পাঠিয়ে অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক নিনা ভূঁইয়া বললেন, সামনে গুগল মিট বা জুমে ক্লাস হবে। সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ রেকর্ড করা ক্লাস অভিভাবকদের হোয়াটসঅ্যাপ আইডিতে পাঠাচ্ছে।

সরকারি স্কুলের নানা রকম
সরকারিভাবে স্কুল পর্যায়ে বিকল্প বলতে আছে সংসদ টিভিতে প্রচারিত ক্লাস। অনলাইনে ক্লাসের কেন্দ্রীয় কোনো সিদ্ধান্ত নেই, তবে বড় স্কুলগুলোর নিজস্ব উদ্যোগ আছে। মাউশির মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক বললেন, অনলাইনে ক্লাসকে তাঁরা উৎসাহিত করছেন।

ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল মার্চের শেষ দিকে ফেসবুক লাইভে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির কিছু কিছু ক্লাস নিতে শুরু করে। কিছুদিন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও ক্লাস চলে। ১৭ এপ্রিল থেকে নিয়মিত চলছে জুমে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া। তিনি বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি। বললেন, ঢাকার মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় ও তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট মহানগরে কয়েকটি উদ্যোগ আছে।

সিলেট সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ জুমে ক্লাস নিচ্ছে। তবে প্রধান শিক্ষক বাবলী পুরকায়স্থ মুঠোফোনে বললেন, পাবলিক পরীক্ষা সামনে রেখে কেবল পঞ্চম, অষ্টম, নবম, দশম ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ক্লাস হচ্ছে। অসচ্ছল পরিবারের মেয়েরা বাদে বেশির ভাগ ছাত্রীই যোগ দিচ্ছে।

খুলনা জেলা প্রশাসন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠের ভিডিও তৈরি করেছে। সেগুলো ইউটিউব এবং ফেসবুকে যাচ্ছে। তবে সরকারি বা বেসরকারি, উদ্যোগগুলো বেশির ভাগই যে যার মতো করে করা।

গুছিয়ে সুশৃঙ্খল একটি পদ্ধতি কি দাঁড় করানো সম্ভব? সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খানের মতে, অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা দুটোই নেওয়া সম্ভব। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখাটা বড় কথা। সুবিধাসম্পন্ন স্কুলকে মাউশি অবিলম্বে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চালু করতে বলুক। অন্যগুলো ইউটিউবে চ্যানেল খুলে ক্লাসের ভিডিও রাখবে।

সাবেক এই শিক্ষাসচিব ১০ জুলাই মুঠোফোনে বললেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যায় থাকা এলাকাগুলো চিহ্নিত করে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে ব্যবস্থা নিতে বলুক। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন নিজেদের বিশেষ তহবিল ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।