ঢাকা , সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
৩ এপ্রিল ছুটি ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্‌ল কোম্পানির সব ধরনের ইন্টারনেটের দাম কমছে ১০ শতাংশ। রমজানে মাধ্যমিক স্কুল খোলা থাকবে ১৫ দিন, প্রাথমিক স্কুল ১০ দিন খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে টেকনাফ সীমান্তের হোয়াইক্যং এলাকা দিয়ে আজ অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মিয়ানমারের সেনা সাদ সাহেব রুজু করার পর দেওবন্দের মাসআলা খতম হয়ে গেছে : মাওলানা আরশাদ মাদানী চলছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিনের বয়ান পুলিশ সদস্যসহ বিশ্ব ইজতেমায় ৭ জনের মৃত্যু বর্তমান সরকারের সঙ্গে সব দেশ কাজ করতে চায়: পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়পুরহাটে স্কুলছাত্র হত্যায় ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড

অপেক্ষার এক আতঙ্কিত প্রহর

  • নিউজ ডেস্ক
  • প্রকাশিত : ০৮:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জুন ২০২০
  • ৮৫৫ পঠিত

ড্রয়িংরুমে বসে মোবাইলে করোনা–সংক্রান্ত আপডেট দেখছিলাম। লকডাউনের কারণে ঘরে বসে অনলাইনে অফিস করছি। বিকেলে হঠাৎ ভাবলাম ছেলের সঙ্গে একটু জ্ঞান বিনিময় করা যাক। আলিফ পঞ্চম শ্রেণিতে, বেশ বিজ্ঞানমনস্ক সে।

-আলিফ, বল তো রক্তচাপ মাপার যন্ত্র কোনটি?

-স্ফিগমোম্যানোমিটার, বাবা।

-বাহ্! শরীরের তাপমাত্রা মাপে কী দিয়ে?

-থার্মোমিটার।

-ঠিক। বায়ুচাপ মাপার যন্ত্রের নাম?

-ব্যারোমিটার।

-এক্সিলেন্ট! বল তো এবার, মৃত্যু মাপার যন্ত্রের নাম কী?

-জানি না তো, বাবা। মৃত্যু কীভাবে মাপে?

অন্যমনস্ক হয়ে গম্ভীরভাবে বললাম,

মৃত্যু পরিমাপক যন্ত্রের নাম ওয়ার্ল্ডোমিটার!

টেবিলে সন্ধ্যার নাশতা পরিবেশনরত স্ত্রী স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শুনে‌, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ! কী বলছ ওকে এসব?’ আমি স্ত্রীর কথা শুনতে পেলাম না! মোবাইলে একটু আগে দেখা ওয়ার্ল্ডোমিটারে মৃতের সংখ্যা চোখে ভাসছে কেবল—৪ লাখ ৩৫ হাজার ৫৯৩!

ওপরের কাহিনিটা কিংবা এর সঙ্গে যুক্ত চরিত্রগুলো কাল্পনিক। আমার কল্পনাপ্রসূত এক ফিকশন। তবে নিছক ফিকশন হিসেবে এটিকে উড়িয়েও দিচ্ছি না। কারণ, করোনাকালে ঘরে বন্দী অবস্থায় মনের অজান্তেই এ ধরনের নানা আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা বা দুঃস্বপ্ন নিয়ে নিয়ত সময় পার করছি। আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচার জন্য, সময়টা একটু ভিন্নভাবে পার করার জন্য বই পড়ি, সিনেমা দেখি, ঘরের কাজ করি, করোনা–পূর্ববর্তী সময়ের কথা চিন্তা করি। কিন্তু আসলে কি চিন্তামুক্ত হতে পারছি? না! গত পরশু সস্ত্রীক একটা হিন্দি সিনেমা দেখছিলাম। সিনেমাটা ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত। সেখানে ভারতীয় অভিনেতা অর্জুন রামপাল তাঁর ছেলের জ্বর নিয়ে চিন্তিত। মনের অজান্তেই মুখে বেরিয়ে এল, ‘আরে! করোনা হতে পারে, টেস্ট করাও।’ পাশে বসে থাকা স্ত্রী প্রথমে হতভম্ব হয়ে পরে হেসে দিল‌। আমিও হেসে দিই, কিন্তু আড়ালের দুশ্চিন্তা হাসে না।

লকডাউন চলাকালে মাঝেমধ্যেই প্রয়োজনে বাজার, ব্যাংকে যেতে হয়। লকডাউনের শুরুতে রাস্তাঘাটে কোনো মানুষ দেখিনি।‌ প্রায় জনশূন্য রাস্তাঘাটে সবকিছু অচেনা, অজানা মনে হতো। এখন যদিও পরিস্থিতি ভিন্ন। অনেক মানুষ বের হচ্ছে জীবনের তাগিদে। তো একদিন ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে রিকশায় করে যাচ্ছি। রিকশাওয়ালা নির্দিষ্ট গন্তব্য ব্যাংকে নামিয়ে দিলেন। নেমে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটাই তো সেই ব্যাংক না?’ অথচ বছরের পর বছর একই ব্যাংক থেকে টাকা তুলছি, বেতন-ভাতা নিচ্ছি। কেন জিজ্ঞাসা করলাম জানি না‌‌। মনে হয়, স্বাভাবিক জীবনে লাগাম টেনে ধরা করোনা দুশ্চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাসও কমিয়ে দিয়েছে।

বাইরে বের হলে মাস্ক পরি, গ্লাভস পরি। যথাসম্ভব সুরক্ষিত থাকার চেষ্টা করি। তবু সব সময় মনে হয়, কোভিড-১৯ মাস্ক ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারবে কি না। খালি চোখে ভাইরাসটি দেখতে পারলে ভালো হতো, আরও সাবধানে থাকতে পারতাম। করোনা শুরুর পর থেকে নিজের কাছে সবচেয়ে অবিশ্বস্ত লাগছে নিজের হাত দুটিকে। মনে হয় হাত দুটো চোখ, নাক, মুখের সংস্পর্শে এসে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। অথচ কয়েক মাস আগেও এই হাত দুটিই ছিল পরম বিশ্বস্ত বন্ধু। ইদানীং হাত দুটিকে মনে হয় ঈশপের গল্পের সেই হরিণের পা। যে দুই জোড়া পা’কে ‘অসুন্দর’ বলে হরিণটা ঘৃণা করলেও বাঘের কবল থেকে বেঁচে পালাতে পাগুলোই তাকে সাহায্য করেছিল দীর্ঘক্ষণ।

ঘুমিয়েও শান্তি পাচ্ছি না ইদানীং। অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছি। এক রাতে দেখি, আমার দেহের ভেতর ‘আবেগ’ ও ‘যুক্তি’ দুই ভাইবোন হিসেবে ঝগড়া করছে । দুজনের কথাবার্তায় চরম বৈপরীত্য।

আবেগ: তুই বলছিস লকডাউনের মধ্যেই সব অফিস খুলে দেওয়া উচিত?

যুক্তি: অবশ্যই! জীবন বাঁচানো ফরজ। জীবনের জন্যই অফিস। কর্মহীন হলে টাকাপয়সা আসে?

আবেগ: দাঁড়া! দাঁড়া! বাইরে বের হয়ে যদি জীবনই না বাঁচে, কর্ম করে কী হবে। কিচ্ছু বুঝতে চাই না। অফিসে যাওয়াই যাবে না।

যুক্তি : তা তো বলবিই! তুই তো ঘরে বসেই সব পেতে চাস!

ঘুম ভেঙে যায়‌। এপাশ-ওপাশ করতে থাকি। কোনো কিছুই আর যুক্তি কিংবা আবেগে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারছি না। করোনা ব্যাখ্যাতীত। জানালা খুলে দিই, আতঙ্কের কালো মেঘ কেটে গিয়ে আলো আসবে এই আশায়।

Tag :
জনপ্রিয়

৩ এপ্রিল ছুটি ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি

অপেক্ষার এক আতঙ্কিত প্রহর

প্রকাশিত : ০৮:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ জুন ২০২০

ড্রয়িংরুমে বসে মোবাইলে করোনা–সংক্রান্ত আপডেট দেখছিলাম। লকডাউনের কারণে ঘরে বসে অনলাইনে অফিস করছি। বিকেলে হঠাৎ ভাবলাম ছেলের সঙ্গে একটু জ্ঞান বিনিময় করা যাক। আলিফ পঞ্চম শ্রেণিতে, বেশ বিজ্ঞানমনস্ক সে।

-আলিফ, বল তো রক্তচাপ মাপার যন্ত্র কোনটি?

-স্ফিগমোম্যানোমিটার, বাবা।

-বাহ্! শরীরের তাপমাত্রা মাপে কী দিয়ে?

-থার্মোমিটার।

-ঠিক। বায়ুচাপ মাপার যন্ত্রের নাম?

-ব্যারোমিটার।

-এক্সিলেন্ট! বল তো এবার, মৃত্যু মাপার যন্ত্রের নাম কী?

-জানি না তো, বাবা। মৃত্যু কীভাবে মাপে?

অন্যমনস্ক হয়ে গম্ভীরভাবে বললাম,

মৃত্যু পরিমাপক যন্ত্রের নাম ওয়ার্ল্ডোমিটার!

টেবিলে সন্ধ্যার নাশতা পরিবেশনরত স্ত্রী স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শুনে‌, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ! কী বলছ ওকে এসব?’ আমি স্ত্রীর কথা শুনতে পেলাম না! মোবাইলে একটু আগে দেখা ওয়ার্ল্ডোমিটারে মৃতের সংখ্যা চোখে ভাসছে কেবল—৪ লাখ ৩৫ হাজার ৫৯৩!

ওপরের কাহিনিটা কিংবা এর সঙ্গে যুক্ত চরিত্রগুলো কাল্পনিক। আমার কল্পনাপ্রসূত এক ফিকশন। তবে নিছক ফিকশন হিসেবে এটিকে উড়িয়েও দিচ্ছি না। কারণ, করোনাকালে ঘরে বন্দী অবস্থায় মনের অজান্তেই এ ধরনের নানা আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা বা দুঃস্বপ্ন নিয়ে নিয়ত সময় পার করছি। আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচার জন্য, সময়টা একটু ভিন্নভাবে পার করার জন্য বই পড়ি, সিনেমা দেখি, ঘরের কাজ করি, করোনা–পূর্ববর্তী সময়ের কথা চিন্তা করি। কিন্তু আসলে কি চিন্তামুক্ত হতে পারছি? না! গত পরশু সস্ত্রীক একটা হিন্দি সিনেমা দেখছিলাম। সিনেমাটা ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত। সেখানে ভারতীয় অভিনেতা অর্জুন রামপাল তাঁর ছেলের জ্বর নিয়ে চিন্তিত। মনের অজান্তেই মুখে বেরিয়ে এল, ‘আরে! করোনা হতে পারে, টেস্ট করাও।’ পাশে বসে থাকা স্ত্রী প্রথমে হতভম্ব হয়ে পরে হেসে দিল‌। আমিও হেসে দিই, কিন্তু আড়ালের দুশ্চিন্তা হাসে না।

লকডাউন চলাকালে মাঝেমধ্যেই প্রয়োজনে বাজার, ব্যাংকে যেতে হয়। লকডাউনের শুরুতে রাস্তাঘাটে কোনো মানুষ দেখিনি।‌ প্রায় জনশূন্য রাস্তাঘাটে সবকিছু অচেনা, অজানা মনে হতো। এখন যদিও পরিস্থিতি ভিন্ন। অনেক মানুষ বের হচ্ছে জীবনের তাগিদে। তো একদিন ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে রিকশায় করে যাচ্ছি। রিকশাওয়ালা নির্দিষ্ট গন্তব্য ব্যাংকে নামিয়ে দিলেন। নেমে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটাই তো সেই ব্যাংক না?’ অথচ বছরের পর বছর একই ব্যাংক থেকে টাকা তুলছি, বেতন-ভাতা নিচ্ছি। কেন জিজ্ঞাসা করলাম জানি না‌‌। মনে হয়, স্বাভাবিক জীবনে লাগাম টেনে ধরা করোনা দুশ্চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাসও কমিয়ে দিয়েছে।

বাইরে বের হলে মাস্ক পরি, গ্লাভস পরি। যথাসম্ভব সুরক্ষিত থাকার চেষ্টা করি। তবু সব সময় মনে হয়, কোভিড-১৯ মাস্ক ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারবে কি না। খালি চোখে ভাইরাসটি দেখতে পারলে ভালো হতো, আরও সাবধানে থাকতে পারতাম। করোনা শুরুর পর থেকে নিজের কাছে সবচেয়ে অবিশ্বস্ত লাগছে নিজের হাত দুটিকে। মনে হয় হাত দুটো চোখ, নাক, মুখের সংস্পর্শে এসে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। অথচ কয়েক মাস আগেও এই হাত দুটিই ছিল পরম বিশ্বস্ত বন্ধু। ইদানীং হাত দুটিকে মনে হয় ঈশপের গল্পের সেই হরিণের পা। যে দুই জোড়া পা’কে ‘অসুন্দর’ বলে হরিণটা ঘৃণা করলেও বাঘের কবল থেকে বেঁচে পালাতে পাগুলোই তাকে সাহায্য করেছিল দীর্ঘক্ষণ।

ঘুমিয়েও শান্তি পাচ্ছি না ইদানীং। অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছি। এক রাতে দেখি, আমার দেহের ভেতর ‘আবেগ’ ও ‘যুক্তি’ দুই ভাইবোন হিসেবে ঝগড়া করছে । দুজনের কথাবার্তায় চরম বৈপরীত্য।

আবেগ: তুই বলছিস লকডাউনের মধ্যেই সব অফিস খুলে দেওয়া উচিত?

যুক্তি: অবশ্যই! জীবন বাঁচানো ফরজ। জীবনের জন্যই অফিস। কর্মহীন হলে টাকাপয়সা আসে?

আবেগ: দাঁড়া! দাঁড়া! বাইরে বের হয়ে যদি জীবনই না বাঁচে, কর্ম করে কী হবে। কিচ্ছু বুঝতে চাই না। অফিসে যাওয়াই যাবে না।

যুক্তি : তা তো বলবিই! তুই তো ঘরে বসেই সব পেতে চাস!

ঘুম ভেঙে যায়‌। এপাশ-ওপাশ করতে থাকি। কোনো কিছুই আর যুক্তি কিংবা আবেগে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারছি না। করোনা ব্যাখ্যাতীত। জানালা খুলে দিই, আতঙ্কের কালো মেঘ কেটে গিয়ে আলো আসবে এই আশায়।