ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
রমজানে মাধ্যমিক স্কুল খোলা থাকবে ১৫ দিন, প্রাথমিক স্কুল ১০ দিন খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে টেকনাফ সীমান্তের হোয়াইক্যং এলাকা দিয়ে আজ অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মিয়ানমারের সেনা সাদ সাহেব রুজু করার পর দেওবন্দের মাসআলা খতম হয়ে গেছে : মাওলানা আরশাদ মাদানী চলছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিনের বয়ান পুলিশ সদস্যসহ বিশ্ব ইজতেমায় ৭ জনের মৃত্যু বর্তমান সরকারের সঙ্গে সব দেশ কাজ করতে চায়: পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়পুরহাটে স্কুলছাত্র হত্যায় ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্প পর্যালোচনায় কমিটি গঠন করলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়

আওয়ামী লীগের কাছে সদুত্তর আছে বলে মনে হয় না

  • নিউজ ডেস্ক
  • প্রকাশিত : ০৬:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ জুলাই ২০২০
  • ৯৮৮ পঠিত

স্বাধীনতার পর থেকে আমরা দেখে এসেছি ক্ষমতায় থাকুক আর বিরোধী দলে থাকুক, আওয়ামী লীগ বরাবর রাজনীতিতে চালকের আসনে ছিল। স্বাধীনতার পর পৌনে চার বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একুশ বছর বিরোধী দলে ছিল। কিন্তু রাজনীতি ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ প্রায় প্রতিটি সরকারের ঘুম হারাম করেছে রাজপথে আন্দোলন–সংগ্রাম করে। এর প্রধান কারণ দলটি গণমানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষা, দাবিদাওয়ার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসত। দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী দেখলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। রাজপথের আন্দোলনে তো ছিলই। সপ্তম, নবম, দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। ফলে সংসদে ও সংসদের বাইরে তাদের একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনীতির ওপর আওয়ামী লীগের সেই নিয়ন্ত্রণ অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। সরকার ও আওয়ামী লীগ এক নয়। সরকার চলে প্রশাসন, আমলা, র‍্যাব, বিজিবি, পুলিশ ইত্যাদি নিয়ে। আর দল চলে নেতা–কর্মীদের নিয়ে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ছিল, নির্বাচনের পরেও ক্ষমতায় আছে। এই দলের কোনো কোনো নেতা বড়াই করে বলেছেন, পঁচাত্তরের পর এই প্রথম আওয়ামী লীগ এককভাবে মসনদে বসার সুযোগ পেয়েছে। সেই সুযোগ দলের জন্য আশীর্বাদ না বোঝা হয়েছে, সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলে রাজনীতিবহির্ভূত শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব–প্রতিপত্তি থাকার অভিযোগ আওয়ামী লীগ নেতারাই বেশি করতেন। এখন বিরোধী দল দুর্বল ও দিগ্‌ভ্রান্ত। ফলে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের জন্য বড় কোনো হুমকি নেই। কিন্তু হুমকি তৈরি হয়েছে দলের ভেতর থেকেই।

কিন্তু সবাইকে যে ধরা হয়নি তার প্রমাণ সাহেদ ও আরিফুল গংয়ের দৌরাত্ম্য। সে সময় অভিযান না থামালে হয়তো জালিয়াত–প্রতারক চক্র এতটা দুঃসাহস দেখাতে পারত না। বিস্ময়কর হলো ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, হাসপাতালের মালিক কিংবা সংসদ সদস্য, যিনি যেখানেই ধরা পড়ুন না কেন, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাঁরা কোনো না কোনোভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের নেতারা এখন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের অপকর্মের দায় অস্বীকার করছেন; তিনি আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে ছিলেন না বলে দাবি করছেন। কিন্তু যখন এই ব্যক্তি আওয়ামী লীগের কোনো কমিটির (তাও যে সে কমিটি নয়, আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটি) সদস্য পরিচয় দিয়ে দিনের পর দিনে টিভিতে হাজির হতেন, নিজেকে ওবায়দুল কাদেরের চেয়েও খাঁটি আওয়ামী লীগার হিসেবে প্রচার করতেন, তখন দলের কোনো পর্যায় থেকে আপত্তি করা হয়নি। এর অর্থ আওয়ামী লীগ তাঁর সেই প্রচারণার প্রতি মৌন সম্মতি দিয়েছিল।

 আওয়ামী লীগের নেতারা কোভিড–১৯ পরীক্ষায় জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত মো. সাহেদকে ধরার কৃতিত্ব দাবি করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আর কেউ নয়, সরকারই সাহেদ–আরিফুল–সাবরিনাদের জালিয়াতি ফাঁস করেছে। এর আগে সম্রাট–পাপিয়াদের বেলায়ও তাঁরা এ রকম দাবি করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা যখন এসব ফলাও করে প্রচার করেন, তখন তাঁদের অন্তত দুটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। এক. এ রকম দুর্ধর্ষ প্রতারক ও জালিয়াত চক্র এত দিন কীভাবে প্রতারণা, জালিয়াতি, মাস্তানি করতে পারল? দুই. তাদের অপকর্মে কারা সহায়তা করেছেন? সাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজের দায় এড়াতে যা বলেছেন, তা হাস্যকর ও অক্ষমের আর্তনাদ বলেই মনে হয়। তিনি বলেছেন, অজস্র চুক্তি হয়, মন্ত্রীরা সব পড়েন না। মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী। মন্ত্রণালয়ের ভালো কাজ করলে তার কৃতিত্ব যেমন তাঁর, তেমনি খারাপ কাজের দায়ও তাঁকে নিতে হবে। সাহেদের দুষ্কর্ম নিয়ে আরও কিছুদিন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলবে। সে নিয়ে পরে লেখা যাবে।

আবার দলের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আওয়ামী লীগ দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করলেও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণের চাবিটি হারিয়ে ফেলেছে। এ কথা আর আড়াল–আবডালের বিষয় নয়। সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে থানার ওসিরাও এটা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কেননা তাঁরা জানেন ২০১৮ সালের নির্বাচনটি কীভাবে হয়েছে, মন্ত্রী–সাংসদেরা কীভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ কিছু নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। সে ভিত্তিটি হলো গণতন্ত্র, মানুষের ভোটের অধিকার এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও ছিল তাই। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সেই নৈতিক ভিত্তিটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা বলতেন, নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ট্রেন মিস করেছে। কিন্তু ২০১৮ সালে অধিকতর প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটের অধিকার রক্ষা করতে পারেনি। ফলে ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আসার অভিযোগটি এখন আর আওয়ামী লীগ নেতাদের একতরফা বয়ান নয়। বিরোধী দলেরও বয়ান। ৩৫০ জন সাংসদের জাতীয় সংসদে আজ বিএনপির সদস্য মাত্র ৮ জন। তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজন—হারুনুর রশীদ ও রুমিন ফারহানার প্রশ্নের জবাব দিতেই আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা সাংসদেরা পর্যন্ত গলদঘর্ম হচ্ছেন। কৌতূহলের সঙ্গে একটি বিষয় লক্ষ করছি, আগে যেকোনো বিষয়ে আওয়ামী লীগ আক্রমণাত্মক অবস্থান নিত। বিএনপি ছিল রক্ষণাত্মক। এখন প্রায় প্রতিদিন আওয়ামী লীগকে বিএনপির প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে।

প্রতিদিন বিএনপির নেতারা বিভিন্ন ইস্যুতে প্রেস ব্রিফিং করেন। সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাদের অসহায় ভঙ্গিতে তার জবাব দিতে হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগের জবাব কিংবা আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপির জবাব পছন্দ না–ও হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলে কিংবা করোনাকালেও হাটে–পথে কান পাতলে দেখতে ও শুনতে পেতেন, সাধারণ মানুষ কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, সরকার ও আওয়ামী লীগের দলের কর্মকাণ্ডকে কী চোখে দেখছে। মামলার ভয় দেখিয়ে বিরোধী দলকে ঠান্ডা করা যায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গ ঝুলিয়ে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠও নরম করা যায়। কিন্তু কোনো ধমক, মামলা, আইন দিয়ে গণমানুষের মুখ বন্ধ করা যায় না।

এত দিন আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরুদ্ধে কারচুপির গণভোট, ক্ষমতায় থেকে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন, প্রশাসন দলীয়করণের অভিযোগ আনত। তাদের সেসব অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিল না। কিন্তু আজ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিএনপিও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছে এবং আওয়ামী লীগের কাছে সদুত্তর আছে বলে মনে হয় না। ক্ষমতাসীন দলের জন্য এটা নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয়ের শামিল।

Tag :
জনপ্রিয়

রমজানে মাধ্যমিক স্কুল খোলা থাকবে ১৫ দিন, প্রাথমিক স্কুল ১০ দিন

আওয়ামী লীগের কাছে সদুত্তর আছে বলে মনে হয় না

প্রকাশিত : ০৬:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ জুলাই ২০২০

স্বাধীনতার পর থেকে আমরা দেখে এসেছি ক্ষমতায় থাকুক আর বিরোধী দলে থাকুক, আওয়ামী লীগ বরাবর রাজনীতিতে চালকের আসনে ছিল। স্বাধীনতার পর পৌনে চার বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একুশ বছর বিরোধী দলে ছিল। কিন্তু রাজনীতি ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ প্রায় প্রতিটি সরকারের ঘুম হারাম করেছে রাজপথে আন্দোলন–সংগ্রাম করে। এর প্রধান কারণ দলটি গণমানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষা, দাবিদাওয়ার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসত। দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী দেখলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। রাজপথের আন্দোলনে তো ছিলই। সপ্তম, নবম, দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। ফলে সংসদে ও সংসদের বাইরে তাদের একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনীতির ওপর আওয়ামী লীগের সেই নিয়ন্ত্রণ অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। সরকার ও আওয়ামী লীগ এক নয়। সরকার চলে প্রশাসন, আমলা, র‍্যাব, বিজিবি, পুলিশ ইত্যাদি নিয়ে। আর দল চলে নেতা–কর্মীদের নিয়ে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ছিল, নির্বাচনের পরেও ক্ষমতায় আছে। এই দলের কোনো কোনো নেতা বড়াই করে বলেছেন, পঁচাত্তরের পর এই প্রথম আওয়ামী লীগ এককভাবে মসনদে বসার সুযোগ পেয়েছে। সেই সুযোগ দলের জন্য আশীর্বাদ না বোঝা হয়েছে, সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলে রাজনীতিবহির্ভূত শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব–প্রতিপত্তি থাকার অভিযোগ আওয়ামী লীগ নেতারাই বেশি করতেন। এখন বিরোধী দল দুর্বল ও দিগ্‌ভ্রান্ত। ফলে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের জন্য বড় কোনো হুমকি নেই। কিন্তু হুমকি তৈরি হয়েছে দলের ভেতর থেকেই।

কিন্তু সবাইকে যে ধরা হয়নি তার প্রমাণ সাহেদ ও আরিফুল গংয়ের দৌরাত্ম্য। সে সময় অভিযান না থামালে হয়তো জালিয়াত–প্রতারক চক্র এতটা দুঃসাহস দেখাতে পারত না। বিস্ময়কর হলো ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, হাসপাতালের মালিক কিংবা সংসদ সদস্য, যিনি যেখানেই ধরা পড়ুন না কেন, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তাঁরা কোনো না কোনোভাবে জড়িত। আওয়ামী লীগের নেতারা এখন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের অপকর্মের দায় অস্বীকার করছেন; তিনি আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে ছিলেন না বলে দাবি করছেন। কিন্তু যখন এই ব্যক্তি আওয়ামী লীগের কোনো কমিটির (তাও যে সে কমিটি নয়, আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটি) সদস্য পরিচয় দিয়ে দিনের পর দিনে টিভিতে হাজির হতেন, নিজেকে ওবায়দুল কাদেরের চেয়েও খাঁটি আওয়ামী লীগার হিসেবে প্রচার করতেন, তখন দলের কোনো পর্যায় থেকে আপত্তি করা হয়নি। এর অর্থ আওয়ামী লীগ তাঁর সেই প্রচারণার প্রতি মৌন সম্মতি দিয়েছিল।

 আওয়ামী লীগের নেতারা কোভিড–১৯ পরীক্ষায় জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত মো. সাহেদকে ধরার কৃতিত্ব দাবি করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আর কেউ নয়, সরকারই সাহেদ–আরিফুল–সাবরিনাদের জালিয়াতি ফাঁস করেছে। এর আগে সম্রাট–পাপিয়াদের বেলায়ও তাঁরা এ রকম দাবি করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা যখন এসব ফলাও করে প্রচার করেন, তখন তাঁদের অন্তত দুটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। এক. এ রকম দুর্ধর্ষ প্রতারক ও জালিয়াত চক্র এত দিন কীভাবে প্রতারণা, জালিয়াতি, মাস্তানি করতে পারল? দুই. তাদের অপকর্মে কারা সহায়তা করেছেন? সাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজের দায় এড়াতে যা বলেছেন, তা হাস্যকর ও অক্ষমের আর্তনাদ বলেই মনে হয়। তিনি বলেছেন, অজস্র চুক্তি হয়, মন্ত্রীরা সব পড়েন না। মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী। মন্ত্রণালয়ের ভালো কাজ করলে তার কৃতিত্ব যেমন তাঁর, তেমনি খারাপ কাজের দায়ও তাঁকে নিতে হবে। সাহেদের দুষ্কর্ম নিয়ে আরও কিছুদিন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলবে। সে নিয়ে পরে লেখা যাবে।

আবার দলের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আওয়ামী লীগ দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করলেও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণের চাবিটি হারিয়ে ফেলেছে। এ কথা আর আড়াল–আবডালের বিষয় নয়। সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে থানার ওসিরাও এটা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কেননা তাঁরা জানেন ২০১৮ সালের নির্বাচনটি কীভাবে হয়েছে, মন্ত্রী–সাংসদেরা কীভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ কিছু নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। সে ভিত্তিটি হলো গণতন্ত্র, মানুষের ভোটের অধিকার এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও ছিল তাই। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সেই নৈতিক ভিত্তিটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা বলতেন, নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ট্রেন মিস করেছে। কিন্তু ২০১৮ সালে অধিকতর প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটের অধিকার রক্ষা করতে পারেনি। ফলে ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আসার অভিযোগটি এখন আর আওয়ামী লীগ নেতাদের একতরফা বয়ান নয়। বিরোধী দলেরও বয়ান। ৩৫০ জন সাংসদের জাতীয় সংসদে আজ বিএনপির সদস্য মাত্র ৮ জন। তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজন—হারুনুর রশীদ ও রুমিন ফারহানার প্রশ্নের জবাব দিতেই আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা সাংসদেরা পর্যন্ত গলদঘর্ম হচ্ছেন। কৌতূহলের সঙ্গে একটি বিষয় লক্ষ করছি, আগে যেকোনো বিষয়ে আওয়ামী লীগ আক্রমণাত্মক অবস্থান নিত। বিএনপি ছিল রক্ষণাত্মক। এখন প্রায় প্রতিদিন আওয়ামী লীগকে বিএনপির প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে।

প্রতিদিন বিএনপির নেতারা বিভিন্ন ইস্যুতে প্রেস ব্রিফিং করেন। সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাদের অসহায় ভঙ্গিতে তার জবাব দিতে হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগের জবাব কিংবা আওয়ামী লীগের কাছে বিএনপির জবাব পছন্দ না–ও হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলে কিংবা করোনাকালেও হাটে–পথে কান পাতলে দেখতে ও শুনতে পেতেন, সাধারণ মানুষ কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, সরকার ও আওয়ামী লীগের দলের কর্মকাণ্ডকে কী চোখে দেখছে। মামলার ভয় দেখিয়ে বিরোধী দলকে ঠান্ডা করা যায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গ ঝুলিয়ে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠও নরম করা যায়। কিন্তু কোনো ধমক, মামলা, আইন দিয়ে গণমানুষের মুখ বন্ধ করা যায় না।

এত দিন আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরুদ্ধে কারচুপির গণভোট, ক্ষমতায় থেকে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন, প্রশাসন দলীয়করণের অভিযোগ আনত। তাদের সেসব অভিযোগ ভিত্তিহীন ছিল না। কিন্তু আজ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিএনপিও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছে এবং আওয়ামী লীগের কাছে সদুত্তর আছে বলে মনে হয় না। ক্ষমতাসীন দলের জন্য এটা নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয়ের শামিল।