দেশে কিটের মজুত কত আছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেটা না জানানোয় একধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।
দেশের সরকারি করোনা পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোর বেশ কয়েকটি কিটের সংকটে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চাহিদার তুলনায় কম কিট সরবরাহ করা হচ্ছে বলে কেন্দ্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। দেশে কিটের মজুত কত আছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেটা না জানানোয় একধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।
গত সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীনের বিশেষজ্ঞ দলকে বিদায় জানাতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বর্তমানে সব দেশেই করোনা পরীক্ষা কিটের চাহিদা বেশি বলে প্রয়োজনীয় কিট পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশে কিটের যে মজুত আছে, তাতে ‘ঘাটতি হবে না’। কোনো কারণে সংকট তৈরি হলেও তা খুব দ্রুত মেটানোর ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে।
গতকাল বুধবার প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, অন্তত ৯টি জেলায় ১২টি পরীক্ষাকেন্দ্রে কিটের সংকট রয়েছে। অধিকাংশ কেন্দ্রে ৩ থেকে ৪ দিন পরীক্ষা চালানোর মতো কিট মজুত রয়েছে।
এখন পর্যন্ত এক দিনে দেশে সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৭ জুন, ১৭ হাজার ৫২৭টি। বর্তমানে ৬৬টি কেন্দ্রে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। কেন্দ্রভিত্তিক পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৫ থেকে ৬টি কেন্দ্রে পরীক্ষা বন্ধ থাকছে।
ঢাকার পর দেশে এখন সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) পরীক্ষাকেন্দ্রে কিটের সংকট রয়েছে। বিআইটিআইডির ল্যাব ইনচার্জ ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, ৩ থেকে ৪ দিনের কিট রয়েছে। চাহিদার চেয়ে কম কিট পাওয়া যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের পাশের জেলা কক্সবাজারেও কিটের সংকট রয়েছে। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অনুপম বড়ুয়া বলেন, প্রতিবারে ৩-৪ দিনের কিট স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া হয়। ঢাকায় গাড়ি পাঠাতে হয়।
নোয়াখালীর দুটি কেন্দ্রে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়। কিটের সংকটের কারণে আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রে গত রবি ও সোমবার নমুনা পরীক্ষা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এর আগের দুই দিন পরীক্ষা হয়েছে মাত্র ৪০টি নমুনা। এই কেন্দ্রে গতকাল প্রায় দেড় হাজার নমুনা পরীক্ষার জন্য জমা ছিল।
আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের করোনা পরীক্ষার ল্যাবের প্রধান সমন্বয়ক ফজলে এলাহী খান প্রথম আলোকে বলেন, কিটের সরবরাহ না থাকা সংকটের প্রধান কারণ। সর্বশেষ তাঁরা ১৩ জুন কিটের চাহিদা দিয়ে তা পেয়েছেন ২২ জুন। এতে দুই দিন নমুনা পরীক্ষা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে।
এই কেন্দ্রে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল, বেগমগঞ্জ উপজেলা, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী ফেনী জেলার নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
কিটের সংকটে আছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা ল্যাবেও। ল্যাবের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর বলেন, তাঁদের বর্তমানে প্রায় ৮০০ নমুনা পরীক্ষা করার মতো কিট মজুত আছে, যা দিয়ে আগামী শনিবার পর্যন্ত পরীক্ষা চালানো যাবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে আট শর মতো কিট মজুত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. শামসুল হক প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিট পাচ্ছি। তবে সেটি পর্যাপ্ত নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চাহিদার তুলনায় কম সরবরাহ করা হয়।’ তিনি বলেন, পরীক্ষাগারে যে কিট আছে, সেটি দিয়ে আর চার দিন পরীক্ষা করা যাবে।
সিলেটের আরেক পরীক্ষাকেন্দ্র এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং সিলেটে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কমিটির চেয়ারম্যান মো. ময়নুল হক বলেন, বর্তমানে প্রায় এক হাজার কিট রয়েছে। সেটি দিয়ে পাঁচ দিন পরীক্ষা করা যাবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চাহিদার তুলনায় কম কিট পাওয়া যাচ্ছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে দুটি পরীক্ষাকেন্দ্রে দুই থেকে তিন দিন পরীক্ষা করার মতো কিট মজুত রয়েছে। তবে ঠিক কত পরিমাণ কিট রয়েছে, তা ল্যাব কর্তৃপক্ষ জানায়নি।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের ল্যাব কমিটির সদস্য ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. আশরাফুল আলম বলেন, মজুত কিট দিয়ে আর মাত্র এক দিন অর্থাৎ আজ বৃহস্পতিবার পরীক্ষা করা সম্ভব। কিট পাওয়া না গেলে শুক্রবারে পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না।
খুলনার পরীক্ষাকেন্দ্রের মজুত কিট দিয়ে তিন থেকে চার দিন কাজ চালানো যাবে। খুলনা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং করোনা শনাক্তকরণ কেন্দ্রের মুখপাত্র এস এম তুষার আলম প্রথম আলোকে বলেন, এখন ৮০০-৯০০ কিট আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাহিদা পাঠালে সেখান থেকে চাহিদার তুলনায় কিছু কম দেয়; যেমন ৩ হাজার কিটের চাহিদা দিলে ২ হাজার পাঠায়।
বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ সূত্র জানায়, এখানে প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষা করা যায় ১৮৮টি। এই কেন্দ্রে পরীক্ষার জন্য জমে আছে ১ হাজার ৭১৭টি নমুনা। ফলে দুই সপ্তাহ আগে নমুনা দিয়েও ফলাফল মিলছে না।
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল আলম বলেন, দুই সপ্তাহ পরীক্ষা কার্যক্রম চালানোর মতো কিট মজুত রয়েছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজে করোনা পরীক্ষার ৪০০ কিট মজুত রয়েছে। মজুত কিট দিয়ে দুই দিনের পরীক্ষা করা সম্ভব। ল্যাবের সার্বিক দায়িত্বে থাকা রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ নুরুন্নবী বলেন, চাহিদার অর্ধেক কিট পাওয়া যায়। দুই দিনের মজুত থাকা অবস্থায় নতুন করে চাহিদা পাঠানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একসময় নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার কিট সংগ্রহ, বিতরণ ও মজুতের তথ্য দিত। সর্বশেষ ১১ এপ্রিল কিটের মজুতের তথ্য জানানো হয়। এরপর কিটের মজুত জানায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
পরীক্ষাকেন্দ্রে কিটের সংকটের বিষয়টিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অব্যবস্থাপনার অংশ বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংক্রমণ বৃদ্ধির সময়ে এমন সংকট নিয়ে পরীক্ষা কার্যক্রম কীভাবে চলছে, সেটি বুঝি না। কিটের মজুত কত আছে, সেটি নিয়মিত জানালে জনগণ আশ্বস্ত থাকবে।’