ঢাকা , বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
৩ এপ্রিল ছুটি ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্‌ল কোম্পানির সব ধরনের ইন্টারনেটের দাম কমছে ১০ শতাংশ। রমজানে মাধ্যমিক স্কুল খোলা থাকবে ১৫ দিন, প্রাথমিক স্কুল ১০ দিন খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে টেকনাফ সীমান্তের হোয়াইক্যং এলাকা দিয়ে আজ অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মিয়ানমারের সেনা সাদ সাহেব রুজু করার পর দেওবন্দের মাসআলা খতম হয়ে গেছে : মাওলানা আরশাদ মাদানী চলছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিনের বয়ান পুলিশ সদস্যসহ বিশ্ব ইজতেমায় ৭ জনের মৃত্যু বর্তমান সরকারের সঙ্গে সব দেশ কাজ করতে চায়: পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়পুরহাটে স্কুলছাত্র হত্যায় ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড

ম্যানিলা পাহাড় ও বিআরটিসির দোতলা বাস

  • নিউজ ডেস্ক
  • প্রকাশিত : ০৮:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুন ২০২০
  • ৬৭১ পঠিত

বিআরটিসির দোতলা বাসটি প্রায় খালি। নিচতলায় কয়েকজন বসে আছেন দুই চেয়ারে একজন করে। ওপরের তলাটা একদম ফাঁকা। বাসটা ধীরগতিতে এগিয়ে চলছে আর বাসচালকের সহকারী (হেলপার) চিৎকার করছেন ১০ নম্বর ১০ নম্বর। দ্রুত পা চালিয়ে বাসটি উঠে পড়েই যেন একটু বিব্রত লাগল! নেমে যাব কি না ভাবছি? সচরাচর বাসে চড়া হয় না, তার মধ্যে করোনাকালের সামাজিক দূরত্বের সতর্কতা হিসেবে গণপরিবহন এড়িয়ে চলার কথা বলা হচ্ছে আর আমি কিনা সেই গণপরিবহনে আসীন হয়ে আছি।

এদিক–সেদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কতটুকু ভুল করছি। যাত্রী খুব কম, যে কজন আছেন, তাঁরা মাস্ক পরে দূরে দূরে বসে আছেন। ভিড় একদম নেই, তবে সামনে যদি যাত্রী ওঠেন? গাদাগাদি হয়? নিজের সার্জিক্যাল মাস্ক আর হ্যান্ড গ্লাভস চেক করে নিলাম। মাস্কটা টেনেটুনে ঠিক জায়গামতো আছে কি না, নিশ্চিত হয়ে ওপরের তলার সিঁড়ি ধরে দোতলায় পৌঁছালাম।

পুরো দোতলায় একজন মাত্র যাত্রী বসে আছেন! সব সিট ফাঁকা। নাহ বাসে চড়ার সিদ্ধান্তটা খারাপ হয়নি, মাঝবরাবর জানালার পাশে একটা সিট ধরে বসে পড়লাম।
আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে, জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময় তীব্র গরম থাকার কথা। জ্যৈষ্ঠ মাস আম, লিচু, কাঁঠাল পাকার মাস। তীব্র গরমে নরম হয়ে সুস্বাদু হয়ে উঠবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার ফলগুলো। তবে মেঘলা আবহাওয়াটা খুব চমৎকার। প্রায় দুই মাস সাধারণ ছুটি কাটিয়ে আজ (৩১ মে) অফিসে আসা হয়েছে। চারটায় অফিস বন্ধ করে বাসায় ফিরছি। অনেক দিন ছুটিতে থাকার পর অফিস করতে এসে কেমন ভয় ভয় লাগছে। ভয় নাকি আতঙ্ক? আতঙ্ক বলতে হবে, সংক্রমিত হওয়ার আতঙ্ক আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার ভয়!
বাস চলতে শুরু করেছে, হিমেল বাতাসে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে বুকভরে শ্বাস নিতে। মাস্কটা কি খুলে ফেলব, আশপাশে সব ফাঁকা সারি সারি চেয়ার। মাস্কটা নিচে নামিয়ে বুকভরে একটা শ্বাস নিলাম। ম্যানিলা পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে ভীষণ সবুজ হয়ে উঠেছে এই কদিনে! দোতলা থেকে খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে পাহাড়টা। পাহাড়টা দালানে ঘের দেওয়া থাকায় রাস্তা থেকে সরাসরি চোখে পড়ে না। দোতলা বাসে বসে দিব্যি চোখে পড়ছে পাহাড়টা, এমনকি পাহাড়ের ওপর গড়ে তোলা সুন্দর দালানটা পর্যন্ত। এই পাহাড়ের আসল নামটা জানি না, এই জায়গার বাসিন্দা এক বন্ধু বলেছিল, ম্যানিলা কোম্পানি এই পাহাড়ের মালিক। সত্য–মিথ্যা জানার চেষ্টা কখনো করিনি, তখন থেকে আমার কাছে এই পাহাড়ের নাম ম্যানিলা পাহাড়!
পাহাড়ের পশ্চিম পাশ জিইসি মোড় দালান–কোঠাতে ঘেরা আর দক্ষিণ পাশের কোলে শিল্পকলা একাডেমি। রাস্তা পেরিয়ে পশ্চিম কূলে আরেক পাহাড়, যার শিরে গরিবউল্লাহ শাহর মাজার। চট্টগ্রাম মানেই পাহাড়, পাহাড়ের শরীর ধরে গড়ে ওঠা শহর, যার প্রান্ত ছুঁয়েছে বঙ্গোপসাগর। কত দিন সমুদ্র দেখা হয় না, কত দিন পাহাড় ছোঁয়া হয় না। সময় এমনো আসে? দরজা–জানালা সব বন্ধ করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয় আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে হবে তাই!
ভালো লাগাতে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে আবার আতঙ্ক এসে চপেটাঘাত করছে খোলামেলা স্বাধীনতায়। কিছু মানুষ কাজের দায়ে বের হয়েছে, মানুষগুলো মাস্কে মুখ ঢেকে ছুটে চলেছে কাজের খোঁজে। ওরা হাসছে নাকি কাঁদছে, বোঝার উপায় নেই। চোখগুলো দেখে বোঝার চেষ্টা করছি ওখানে আতঙ্ক লুকানো কি না। আতঙ্ক–জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার, নাকি অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে আবেগহীন দৃষ্টিপাত? ছুটে চলছে সবাই যার যার গন্তব্যের পথে, ঠিকানা সে থাক জানা আর অজানা। মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা জীর্ণশীর্ণ কিছু মানুষও আছে, যাদের দৃষ্টিজুড়ে কিছু কৃপালাভের আশা, তাদের চোখগুলো অস্থির সদয় কোনো দাতার খোঁজে।
অনিশ্চিত সময়ের মতো ছুটে যাচ্ছে যন্ত্রযানটি, হেলেদুলে সে ওয়াসা মোড় পেরিয়ে লালখান বাজারে এসে দাঁড়াল। যাত্রী ওঠা–নামা করছে, তবে সংখ্যায় নেহাত কম। সব খুলে দেওয়া হলেও সবাই এখনো প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছে না বোঝা যায়। এতক্ষণ পর দোতলায় দুজন যাত্রী উঠে এলেন। মানুষ দেখে আমার আত্মা যেন সতর্ক করে দিল আমার হাতকে। মাস্কটা আবার জায়গামতো নাক আর মুখের ওপর চেপে বসেছে। হ্যাঁ, এখন মনে হয় আমি নিরাপদ।
আমি অতিক্রম করতে যাচ্ছি পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর রাস্তাটি। লালখান বাজার থেকে টাইগার পাস দুই পাহাড়ের খাঁজে গড়ে তোলা চমৎকার এক পথ। একটু বাড়িয়ে বলছি মনে হলে ক্ষমা প্রত্যাশা করছি। আমরা যারা চট্টগ্রামে বেড়ে উঠেছি, তাদের কাছে রাস্তাটির আবেগ একটু গভীর। তীব্র গরমেও রাস্তাটি শীতল বাতাসে জুড়িয়ে দেবে পথচারীর প্রাণ, শীত আসার আগের এই রাস্তায় ভেসে আসে শীতের ঘ্রাণ।
পাহাড়গুলো অনেক বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে। পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো যেন হাসছে গা দুলিয়ে দুলিয়ে। লকডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহে একবার এই পথ দিয়ে যেতে হয়েছিল। অন্য যানবাহন না থাকায় রিকশায় চড়েছিলাম, গাড়ি–ঘোড়াশূন্য এই রাস্তার দুই পাশে পাখির কাকলি শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। আমার মন তখন কান পেতে শুনেছিল পাখিদের গান, আজ আবার কান পেতে রইলাম ওদের গান শুনার আশায়। নাহ, কোনো শব্দ নেই, মানুষ দেখলে কি ওরা চুপ করে যায়? নাকি বিস্মিত হয়ে দেখে সৃষ্টির সেরা জীবদের কীর্তিকলাপ।
একে একে মোড়গুলো পাড়ি দিয়ে আমি গন্তব্যের একেবারে কাছাকাছি। হেলপারের ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে বাম পা সামনে বাড়িয়ে নেমে এলাম নিজ ঠিকানায়। ভাইরাস নিয়ে ভাবতে ভাবতে আর ভালো লাগে না, প্রতিদিন আত্মীয়–অনাত্মীয় হারানোর খবর। এই শহরের হাসপাতালের বেড সব কানায় কানায় পূর্ণ। বাতাসে ভর্তি অনেক অক্সিজেন, কিন্তু অনেকে তা টেনে নিতে পারছে না। অক্সিজেন দেওয়া যায়, এমন জায়গার বড় অভাব হয়ে গেছে। কেউ হাত–পা গুটিয়ে বসে নেই, সবাই ছুটছে কী করা যায় তা নিয়ে। এই বন্দরের দঙ্গল দঙ্গল মানুষ কেমন গুটিয়ে গেছে, লুকিয়ে আছে আরও কিছুদিন বাঁচার আশায়। আমার শহরটি এখন পার করছে কঠিন করোনাকাল।

Tag :
জনপ্রিয়

৩ এপ্রিল ছুটি ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি

ম্যানিলা পাহাড় ও বিআরটিসির দোতলা বাস

প্রকাশিত : ০৮:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুন ২০২০

বিআরটিসির দোতলা বাসটি প্রায় খালি। নিচতলায় কয়েকজন বসে আছেন দুই চেয়ারে একজন করে। ওপরের তলাটা একদম ফাঁকা। বাসটা ধীরগতিতে এগিয়ে চলছে আর বাসচালকের সহকারী (হেলপার) চিৎকার করছেন ১০ নম্বর ১০ নম্বর। দ্রুত পা চালিয়ে বাসটি উঠে পড়েই যেন একটু বিব্রত লাগল! নেমে যাব কি না ভাবছি? সচরাচর বাসে চড়া হয় না, তার মধ্যে করোনাকালের সামাজিক দূরত্বের সতর্কতা হিসেবে গণপরিবহন এড়িয়ে চলার কথা বলা হচ্ছে আর আমি কিনা সেই গণপরিবহনে আসীন হয়ে আছি।

এদিক–সেদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কতটুকু ভুল করছি। যাত্রী খুব কম, যে কজন আছেন, তাঁরা মাস্ক পরে দূরে দূরে বসে আছেন। ভিড় একদম নেই, তবে সামনে যদি যাত্রী ওঠেন? গাদাগাদি হয়? নিজের সার্জিক্যাল মাস্ক আর হ্যান্ড গ্লাভস চেক করে নিলাম। মাস্কটা টেনেটুনে ঠিক জায়গামতো আছে কি না, নিশ্চিত হয়ে ওপরের তলার সিঁড়ি ধরে দোতলায় পৌঁছালাম।

পুরো দোতলায় একজন মাত্র যাত্রী বসে আছেন! সব সিট ফাঁকা। নাহ বাসে চড়ার সিদ্ধান্তটা খারাপ হয়নি, মাঝবরাবর জানালার পাশে একটা সিট ধরে বসে পড়লাম।
আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে, জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময় তীব্র গরম থাকার কথা। জ্যৈষ্ঠ মাস আম, লিচু, কাঁঠাল পাকার মাস। তীব্র গরমে নরম হয়ে সুস্বাদু হয়ে উঠবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার ফলগুলো। তবে মেঘলা আবহাওয়াটা খুব চমৎকার। প্রায় দুই মাস সাধারণ ছুটি কাটিয়ে আজ (৩১ মে) অফিসে আসা হয়েছে। চারটায় অফিস বন্ধ করে বাসায় ফিরছি। অনেক দিন ছুটিতে থাকার পর অফিস করতে এসে কেমন ভয় ভয় লাগছে। ভয় নাকি আতঙ্ক? আতঙ্ক বলতে হবে, সংক্রমিত হওয়ার আতঙ্ক আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার ভয়!
বাস চলতে শুরু করেছে, হিমেল বাতাসে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে বুকভরে শ্বাস নিতে। মাস্কটা কি খুলে ফেলব, আশপাশে সব ফাঁকা সারি সারি চেয়ার। মাস্কটা নিচে নামিয়ে বুকভরে একটা শ্বাস নিলাম। ম্যানিলা পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে ভীষণ সবুজ হয়ে উঠেছে এই কদিনে! দোতলা থেকে খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে পাহাড়টা। পাহাড়টা দালানে ঘের দেওয়া থাকায় রাস্তা থেকে সরাসরি চোখে পড়ে না। দোতলা বাসে বসে দিব্যি চোখে পড়ছে পাহাড়টা, এমনকি পাহাড়ের ওপর গড়ে তোলা সুন্দর দালানটা পর্যন্ত। এই পাহাড়ের আসল নামটা জানি না, এই জায়গার বাসিন্দা এক বন্ধু বলেছিল, ম্যানিলা কোম্পানি এই পাহাড়ের মালিক। সত্য–মিথ্যা জানার চেষ্টা কখনো করিনি, তখন থেকে আমার কাছে এই পাহাড়ের নাম ম্যানিলা পাহাড়!
পাহাড়ের পশ্চিম পাশ জিইসি মোড় দালান–কোঠাতে ঘেরা আর দক্ষিণ পাশের কোলে শিল্পকলা একাডেমি। রাস্তা পেরিয়ে পশ্চিম কূলে আরেক পাহাড়, যার শিরে গরিবউল্লাহ শাহর মাজার। চট্টগ্রাম মানেই পাহাড়, পাহাড়ের শরীর ধরে গড়ে ওঠা শহর, যার প্রান্ত ছুঁয়েছে বঙ্গোপসাগর। কত দিন সমুদ্র দেখা হয় না, কত দিন পাহাড় ছোঁয়া হয় না। সময় এমনো আসে? দরজা–জানালা সব বন্ধ করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয় আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে হবে তাই!
ভালো লাগাতে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে আবার আতঙ্ক এসে চপেটাঘাত করছে খোলামেলা স্বাধীনতায়। কিছু মানুষ কাজের দায়ে বের হয়েছে, মানুষগুলো মাস্কে মুখ ঢেকে ছুটে চলেছে কাজের খোঁজে। ওরা হাসছে নাকি কাঁদছে, বোঝার উপায় নেই। চোখগুলো দেখে বোঝার চেষ্টা করছি ওখানে আতঙ্ক লুকানো কি না। আতঙ্ক–জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার, নাকি অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে আবেগহীন দৃষ্টিপাত? ছুটে চলছে সবাই যার যার গন্তব্যের পথে, ঠিকানা সে থাক জানা আর অজানা। মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা জীর্ণশীর্ণ কিছু মানুষও আছে, যাদের দৃষ্টিজুড়ে কিছু কৃপালাভের আশা, তাদের চোখগুলো অস্থির সদয় কোনো দাতার খোঁজে।
অনিশ্চিত সময়ের মতো ছুটে যাচ্ছে যন্ত্রযানটি, হেলেদুলে সে ওয়াসা মোড় পেরিয়ে লালখান বাজারে এসে দাঁড়াল। যাত্রী ওঠা–নামা করছে, তবে সংখ্যায় নেহাত কম। সব খুলে দেওয়া হলেও সবাই এখনো প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছে না বোঝা যায়। এতক্ষণ পর দোতলায় দুজন যাত্রী উঠে এলেন। মানুষ দেখে আমার আত্মা যেন সতর্ক করে দিল আমার হাতকে। মাস্কটা আবার জায়গামতো নাক আর মুখের ওপর চেপে বসেছে। হ্যাঁ, এখন মনে হয় আমি নিরাপদ।
আমি অতিক্রম করতে যাচ্ছি পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর রাস্তাটি। লালখান বাজার থেকে টাইগার পাস দুই পাহাড়ের খাঁজে গড়ে তোলা চমৎকার এক পথ। একটু বাড়িয়ে বলছি মনে হলে ক্ষমা প্রত্যাশা করছি। আমরা যারা চট্টগ্রামে বেড়ে উঠেছি, তাদের কাছে রাস্তাটির আবেগ একটু গভীর। তীব্র গরমেও রাস্তাটি শীতল বাতাসে জুড়িয়ে দেবে পথচারীর প্রাণ, শীত আসার আগের এই রাস্তায় ভেসে আসে শীতের ঘ্রাণ।
পাহাড়গুলো অনেক বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে। পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো যেন হাসছে গা দুলিয়ে দুলিয়ে। লকডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহে একবার এই পথ দিয়ে যেতে হয়েছিল। অন্য যানবাহন না থাকায় রিকশায় চড়েছিলাম, গাড়ি–ঘোড়াশূন্য এই রাস্তার দুই পাশে পাখির কাকলি শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। আমার মন তখন কান পেতে শুনেছিল পাখিদের গান, আজ আবার কান পেতে রইলাম ওদের গান শুনার আশায়। নাহ, কোনো শব্দ নেই, মানুষ দেখলে কি ওরা চুপ করে যায়? নাকি বিস্মিত হয়ে দেখে সৃষ্টির সেরা জীবদের কীর্তিকলাপ।
একে একে মোড়গুলো পাড়ি দিয়ে আমি গন্তব্যের একেবারে কাছাকাছি। হেলপারের ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে বাম পা সামনে বাড়িয়ে নেমে এলাম নিজ ঠিকানায়। ভাইরাস নিয়ে ভাবতে ভাবতে আর ভালো লাগে না, প্রতিদিন আত্মীয়–অনাত্মীয় হারানোর খবর। এই শহরের হাসপাতালের বেড সব কানায় কানায় পূর্ণ। বাতাসে ভর্তি অনেক অক্সিজেন, কিন্তু অনেকে তা টেনে নিতে পারছে না। অক্সিজেন দেওয়া যায়, এমন জায়গার বড় অভাব হয়ে গেছে। কেউ হাত–পা গুটিয়ে বসে নেই, সবাই ছুটছে কী করা যায় তা নিয়ে। এই বন্দরের দঙ্গল দঙ্গল মানুষ কেমন গুটিয়ে গেছে, লুকিয়ে আছে আরও কিছুদিন বাঁচার আশায়। আমার শহরটি এখন পার করছে কঠিন করোনাকাল।