মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে প্রচলিত পোশাকের চাহিদা কমে গেলেও পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বা ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পোশাকশিল্পের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা নতুন এসব পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগও করেছেন। মাস্ক ও গাউনের মতো সুরক্ষা পোশাক রপ্তানিও শুরু হয়েছে।
করোনার কারণে পোশাকশিল্পের ৩১৮ কোটি ডলারের রপ্তানি ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়। ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রায় এক মাস কারখানাও বন্ধ থাকে। এতে করে এপ্রিলে পোশাক রপ্তানি তলানিতে ঠেকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, এপ্রিল মাসে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা গত প্রায় এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এপ্রিলের পর মে মাসে রপ্তানি হয় ১২৩ কোটি ডলারের পোশাক। আর জুনে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ২২৫ কোটি ডলারে। সব মিলিয়ে সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ৬১৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি কমে গেছে।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানায়, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে গত মে মাস পর্যন্ত ৪৪ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের মাস্ক ও গাউনের মতো সুরক্ষাসামগ্রী রপ্তানি হয়েছে। এটি ১১ মাসের চিত্র হলেও সুরক্ষাসামগ্রী রপ্তানির পুরোটাই হয়েছে করোনাকালে। তার মধ্যে অবশ্য পোশাকের পাশাপাশি মেডিকেল পণ্যও রয়েছে। বর্তমানে ৩০টির মতো রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা পিপিই নিয়ে কাজ করছে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাজার গবেষণা ও কনসালটিং কোম্পানি গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্যানুযায়ী, গত বছর বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর বাজার ছিল ৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের। ২০২৭ সালে সেটি বেড়ে ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। অবশ্য ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর বাজার বিশ্লেষণ প্রতিবেদনটি তারা গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করেছে। গত চার মাসে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তাতে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর চাহিদা হু হু করে বাড়ছে।
পিপিই গাউন রপ্তানিতে প্রথম সারিতে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের টেক্সটাইল ডিভিশন। গত মে মাসে ৬৫ লাখ পিস পিপিই গাউনের প্রথম চালানটি এমিরেটসের একটি উড়োজাহাজে পাঠায় তারা। যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ইমারজেন্সি এজেন্সির (এফইএমএ) জন্য দেশটির পোশাকের ব্র্যান্ড হেইনস এই পিপিই গাউন বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে।
রপ্তানির পাশাপাশি দেশের বাজারেও পিপিই গাউন সরবরাহ করছে বেক্সিমকো। সে জন্য আলাদা করে পিপিই ডিভিশন চালু করা হয়েছে। এসব তথ্য দিয়ে বেক্সিমকোর টেক্সটাইল ডিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ নাভিদ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী বছর ৫০ কোটি ডলারের পিপিই রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছি আমরা। আশা করছি, সেটি সহজেই অর্জন করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে দেশের বাজারে ১ হাজার কোটি টাকার পিপিই সরবরাহ করতে চাই আমরা।’
বেক্সিমকোর কারখানায় বর্তমানে মাসে ৫ লাখ পিস গাউন, মাস্ক, জুতার কভার ও সুরক্ষা চশমা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে জানিয়ে সৈয়দ নাভিদ হোসেন বলেন, ‘করোনায় প্রচলিত পোশাকের চাহিদা কমেছে। তবে সুরক্ষা পোশাকের চাহিদা আকাশচুম্বি। আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে পিপিই উৎপাদনে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছি।’
এদিকে, ১৯৮৪ সাল থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে উর্মি গ্রুপ। সুরক্ষা পোশাক উৎপাদনের জন্য ইতিমধ্যে ৫ লাখ মার্কিন ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চীনা কনসালটেন্টের সহায়তা নিয়ে ৩টি নকশার পিপিই গাউন প্রস্তুত করছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির জন্য ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) সনদের জন্যও আবেদন করেছে তৈরি পোশাকশিল্পের স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠান।
বিষয়টি নিশ্চিত করে উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করছি শিগগিরই আমরা এফডিএ সনদ পাব। তার পরই ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ নেওয়া শুরু করব। ইতিমধ্যে ৪-৫টি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শুরুতে মাসে আড়াই লাখ পিস লেবেল ২ ও ৩ গ্রেডের পিপিই গাউন আমরা উৎপাদন করতে চাই।’
উদ্যোক্তারা জানালেন, পণ্যের নকশা উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয় সনদ পাওয়ার প্রক্রিয়াটি কিছুটা দীর্ঘ হওয়ায় এখন পর্যন্ত বড় আকারে পিপিই গাউন রপ্তানি শুরু হয়নি। তবে ফেস মাস্ক রপ্তানি হচ্ছে অনেক। গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ৪ মাসে ১ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের ফেস মাস্ক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭৪৪ শতাংশ বেশি। গত বছরের মার্চ-জুনে রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ১৭ লাখ ডলারের ফেস মাস্ক।
ফ্রান্সের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৬ লাখ পিস ফেস মাস্ক রপ্তানি করেছে স্নোটেক্স গ্রুপ। দেশের বাজারে নিজেদের পোশাকের ব্র্যান্ড সারা লাইফস্টাইলের মাধ্যমে ২ লাখ পিপিই গাউন বিক্রি করেছে তারা। পিপিই গাউন রপ্তানি করতে শিগগিরই জোরেশোরে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ প্রথম আলাকে বলেন, ‘করোনার শুরুর দিকে আমরা আমাদের স্নোটেক্স আউটারওয়্যার কারখানায় পিপিই গাউন তৈরি করেছি। তবে আগস্ট পর্যন্ত জ্যাকেটের ক্রয়াদেশের চাপ থাকায় আপাতত সেদিকে নজর দেওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া বিদেশের পরীক্ষাগারে পিপিই গাউন পরীক্ষা ও সনদ নেওয়াটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রচুর অর্থও বিনিয়োগ করতে হয়। তবে পিপিই গাউনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই আমরা শিগগিরই আবার সেদিকে নজর দেব।’
পোশাক ও বস্ত্র খাতের আরেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকস লিমিটেড। তারা ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ৫ লাখ পিস ফেস মাস্ক রপ্তানি করেছে। শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় আরও ফেস মাস্ক রপ্তানি হবে। অন্যদিকে পিপিই গাউন তৈরির জন্য দুই ধরনের কাপড় উৎপাদন করছে। করোনাপ্রতিরোধী বিশেষ কাপড় উৎপাদন করলেও পরীক্ষাগারের চূড়ান্ত প্রতিবেদন এখনো পায়নি তারা।