‘হুমায়ূনের ভুবন’ সামলানোর দায়িত্ব যিনি নিজে কাঁধে তুলে নিয়েছেন, সেই রাহাত জামিলই দিলেন চমকপ্রদ তথ্যটি, ‘হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে বেশ কয়েকজন উচ্চতর গবেষণা করছেন। যাঁদের একজন পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনও করেছেন।’
লাখো পাঠকের মনে যে লেখকের ঠাঁই হয়েছে, তাঁর সাহিত্য নিয়ে নানা মাত্রিক গবেষণা হবে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? আছে। কারণ, রাহাত বলেছেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রিসম্পন্নকারী হিসেবে এখন পর্যন্ত ড. সানজিদা ইসলামের নামই জানা যায়।’ তরুণ রাহাত জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পাঁড় ভক্ত। প্রিয় লেখকের সৃষ্টি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে অনলাইনে গড়ে তুলেছেন ‘হুমায়ূনের ভুবন’। সানজিদার সঙ্গে যোগাযোগটাও তাঁর মাধ্যমেই হলো।
সানজিদা ইসলাম এখন নেত্রকোনার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক। করোনাকালে থাকছেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে, নিজের বাড়িতে। কথা বলতে গিয়ে বোঝা গেল মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক বেহাল। অগত্যা আলাপ এগোল মেসেঞ্জারে, লিখে লিখে।
হুমায়ূন কথাসাহিত্যে স্বাদেশিক চেতনা
সানজিদা ইসলামের গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে স্বাদেশিক চেতনা’। তিনি হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপলব্ধির অনুসন্ধান করতে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন। সানজিদা বলছিলেন, ‘স্বাদেশিক চেতনা হলো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর দেশপ্রেমের অনুভূতি। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে স্বাদেশিক চেতনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এই চেতনার বাইরে কোনো সাহিত্যিক থাকেন না। হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে স্বাদেশিক চেতনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমিও নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি।’
সানজিদার পিএইচডি পর্ব শুরু হয়েছিল ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ হোসাইন। দীর্ঘ ছয় বছর হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে স্বাদেশিক চেতনার সন্ধান করে সানজিদা ইসলাম অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি।
বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়ে সানজিদা ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ওপর হুমায়ূন আহমেদের ৯টি উপন্যাস ও ৯টি গল্প ঘিরে আমার থিসিসের মূল বিষয় ছিল। স্যারের আত্মদর্শন, দেশের প্রতি ভালোবাসা ফুটে উঠেছে এসব লেখায়। তাঁর প্রতিটি রচনাই অনন্য, তার মধ্যে জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প, অনীল বাগচীর একদিন, ১৯৭১, শ্যামল ছায়ার কথা আলাদা করে বলব আমি। গবেষণার ছয়টি বছর কোনো দিন আমি ক্লান্ত হইনি। বরং কোনো কোনো রাত পার করেছি বই পড়ে। এত সাবলীল ভাষা আর জটিল প্রেক্ষাপটকে সহজ উপস্থাপনা আর কে করতে পারে।
তাঁর তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ড. খালেদ হোসাইন বলেন, ‘সানজিদার বিষয় নির্বাচনটি প্রশংসনীয়। আঞ্চলিকতার কারণেই হুমায়ূন আহমেদের প্রতি বা তাঁর সাহিত্যের প্রতি আলাদা টান ছিল ওর মধ্যে। গবেষণাকাজটি ভালোভাবে সম্পন্ন করতে সে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে, অন্বেষণের চেষ্টা করেছে। আসলে হুমায়ূন আহমেদ বাঙালি মধ্যবিত্তের অনুভূতি, বাংলার মৃত্তিকা, বাস্তব প্রকৃতি, ভাষা, নিজস্ব জীবনের গভীরতা যেভাবে লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন, তা অতুলনীয়। তাঁকে নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত।’
গবেষণার মাঠে নেমে বুঝলেন, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিককে নিয়ে তেমন কোনো গবেষণাই হয়নি। সাধারণ তথ্য-উপাত্ত পেতেও তাই লেখকের পরিচিতদের পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় যেতে হচ্ছে। সানজিদা বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তি ও কর্মজীবনের বিভিন্ন সঙ্গীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। সেই সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বিভিন্নজনের লেখা থেকে তথ্য নিয়েছি। হুমায়ূনের কথাসাহিত্য ও স্বদেশ চেতনার সমন্বয়ের মাধ্যমে আলোচনা করেছি।’
নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়েও সানজিদা ইসলাম সব সময় চেয়েছেন তাঁর গবেষণার প্রতিটি ধাপে যেন তত্ত্বাবধায়ক খালেদ হোসাইন সন্তোষ প্রকাশ করেন। করেছেনও তাই। শিক্ষার্থীর একাগ্রতায় সবচেয়ে খুশি তো শিক্ষকই হন। তাই তো সানজিদা বলছিলেন, ‘শিক্ষক বা গুরুজনেরা সব সময় আদর, শাসন, আগ্রহ, অনাগ্রহে ছোটদের ভালো ও নতুনের দিকেই নিয়ে যান। আমিও সেই চেষ্টাতেই হয়তো আমার কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছি।’
হুমায়ূনে বুঁদ
ছোটবেলা থেকেই হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন। বুঁদ হয়ে পড়েছেন বাঙালির মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প। লেখকের সৃষ্ট চরিত্র হিমু-রূপা-মিসির আলী কিংবা মাজেদা খালার সামনে কতভাবেই না নিজেকে হাজির করেছেন। হুমায়ূন আহমেদকে কেন ভালো লাগে? সানজিদা রহমান বললেন, তিনি মনোজগতের সঙ্গে জীবন–বাস্তবতার চিত্র এমনভাবে লিখেছেন, যেন চোখের সামনে খেলা করে।
সেই ভালো লাগা থেকেই একসময় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, গবেষণার বিষয় হুমায়ূনসাহিত্য কেন নয়। সানজিদা বলছিলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ দেশের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় কথাশিল্পী। শরৎসাহিত্য যদি পিএইচডির বিষয় হয়, হুমায়ূনকে নিয়ে হবে না কেন?’
প্রশ্নের উত্তরটা সানজিদা ইসলাম নিজেই দিয়েছেন নিজের গবেষণা সম্পন্ন করে।
একজন সানজিদা
কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলায় সানজিদা ইসলামের বাড়ি। পড়াশোনার শুরু সেখানেই। ১৯৯৯ সালে বাজিতপুর রাজ্জাকুন্নেছা (আরএন) সরকারি পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে। ২০০৬ সালে বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেছেন বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে। একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর করতে ভর্তি হয়েছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাতালিকায় ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন স্নাতকোত্তর পরীক্ষায়। তারপরই মনোযোগী হন গবেষণায়। গবেষণার সমান্তরালে সামলেছেন সংসার। স্বামী মো. সুমন ও মেয়ে ফাহমিদা ফাইজাকে নিয়ে তাঁর সে ছোট সংসার।
শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি বলে হাতে বেশ সময় পেয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে কাজ করছেন। অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন নতুন হুমায়ূন গবেষকদের। সানজিদা বলছিলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে আমার সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করেছেন। আমিও আগ্রহ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলি। ভালো লাগে, পাঠকপ্রিয় লেখকের সৃষ্টির নতুন আঙ্গিক খুঁজে বের করার এই প্রয়াস।’