বেড়া উপজেলার উত্তর পেঁচাকোলা গ্রামের মাবিয়া খাতুনের বাড়িতে চার-পাঁচ দিন ধরে বন্যার পানি উঠেছে। আজ বসতঘর থেকে পানি নামলেও গোয়ালঘর ও উঠানে এখনো পানি। এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে চরম দুর্ভোগে দিন কাটছে মাবিয়া খাতুনের। তবে এ নিয়ে তিনি যতটা না বিচলিত, তার চেয়ে বেশি বিচলিত তাঁর চারটি গরু নিয়ে।
কারণ, গরুগুলো টানা তিন দিন বন্যার পানিতে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কয়েক দিন ধরে ভালো খাবারও দিতে পারছেন না তিনি। এতে গরুগুলোর শরীর যেমন ভেঙে পড়েছে, তেমনি অসুস্থও হয়ে পড়েছে। অথচ কয়েক দিনের মধ্যেই এগুলোকে কোরবানির হাটে তোলার কথা। এরই মধ্যে খবর পেয়েছেন, কোরবানির হাটে গরুর ক্রেতা নেই।
মাবিয়া বলেন, ‘এনজিওর ঋণে এক বছর ধইর্যা গরুগুল্যা লালন-পালন করতেছি। করোনা রোগের জন্যে এমনিতেই এবারের কোরবানির হাটে গরুর দাম নাই। এর ওপর বন্যা আইস্যা আরও সর্বনাশ কইর্যা দিল। অসুস্থ গরুগুল্যাক ঠিকমতো খাওয়া ও চিকিৎসা দিব্যারও পারত্যাছি না। গরুগুল্যা যেন গলার কাঁটা হয়া দাঁড়াইছে।’
মাবিয়া খাতুনের মতোই গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন উপজেলার অসংখ্য বন্যাদুর্গত মানুষ। এমনিতেই করোনার কারণে এসব মানুষের আয়রোজগার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, সেখানে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে বন্যা হানা দিয়েছে। বন্যার্তরা যেখানে নিজেরাই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন, সেখানে চড়া দামের গোখাদ্য জোগাড় করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তাঁরা। ফলে অনেক স্বপ্ন নিয়ে লালন-পালন করা গরুগুলো এখন তাঁদের কাছে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বন্যায় বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় অনেকেই তাঁদের গরুগুলোকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ উঁচু জায়গায় নিয়ে গেছেন। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে বাড়িতেই রেখেছেন। বাড়িতে রাখা গরুগুলোকে টানা তিন থেকে চার দিন বন্যার পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। ফলে এসব গরুর বেশির ভাগই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
আজ উপজেলার বন্যাকবলিত মালদাপাড়া, দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা ও পেঁচাকোলা গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বন্যার পানি কমলেও বেশির ভাগ বাড়িতে বসবাসের উপযোগী অবস্থা তৈরি হয়নি। ফলে গবাদিপশু নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া অনেক পরিবার এখনো বাড়ি ফিরতে পারেনি। এরই মধ্যে আবার গোখাদ্যের দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় গরুগুলোকে অনাহারে–অর্ধাহারে রাখতে হচ্ছে। এতে গাভিগুলোর দুধ দেওয়ার ক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে। পাশাপাশি কোরবানির হাটকে সামনে রেখে লালন-পালন করা গরুগুলোরও ব্যাপক স্বাস্থ্যহানি হয়েছে।
দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা গ্রামের প্রধান ও খামারি ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘আমাগরে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গরু পালন করা হয়। বন্যার পানি বেশির ভাগ বাড়িতে ঢোকায় গরুগুল্যা অসুস্থ হয়া পড়তেছে।’
মালদাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউপি সদস্য বাবু মিয়া বলেন, ‘বন্যায় আমার ওয়ার্ডের বেশির ভাগ মানুষই গরু নিয়ে চরম বিপদে আছেন। যে সময়ে গরুগুলোকে ভালো খাইয়ে মোটাতাজা করার কথা, সে সময়েই গরুগুলোকে তাঁরা ভালো খাবার দিতে পারছেন না।’
বেড়া উপজেলা দেশের অন্যতম গরু লালন-পালনকারী এলাকা বলে পরিচিত। কোরবানির হাট সামনে রেখে এবার উপজেলায় অন্তত ২৫ হাজার গরু পালন করা হয়েছে। এ ছাড়া দুগ্ধ উৎপাদনের জন্যও রয়েছে প্রচুর গাভি। এবারের বন্যায় উপজেলার আটটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গৌরচন্দ্র সাহা বলেন, ‘বেড়ায় কিছুটা ধীরগতিতে পানি বাড়ায় মানুষ সহজেই উঁচু জায়গায় গরুগুলোকে সরাতে পেরেছে। এতে বেশি সময় গরুগুলোকে বন্যার পানিতে থাকতে হয়নি বলে অসুস্থতার পরিমাণ তুলনামূলক কম। এরপরও মাঠকর্মীদের নিয়ে আমরা বন্যাকবলিত এলাকার গবাদিপশুর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি।’