‘জন্মিলে মরিতে হইবে’- এটাই পৃথিবীর নিয়ম। করোনা বা অন্য কোনো রোগ-শোকে বা যে কোনো কারণে আমরা সবাই একদিন মারা যাব। মারা যাওয়ার পর সবার ইচ্ছে থাকে নিজ জন্মভূমি বা এলাকায় তার দাফন, সৎকার হোক। যাতে আপনজনরা তার কবর দেখে বিশেষ দিনগুলোয় তাকে স্মরণ করে, তার জন্য দোয়া করে। এ জন্য অনেকে মৃত্যুর আগে শেষইচ্ছা হিসেবে তার লাশ দাফনের স্থানের কথা জানিয়ে দেন।
করোনা বিপর্যয় শুরু হওয়ার পর এ রোগে মৃতদের দাফন করা নিয়ে নানা ঘটনা জানা গেছে। রাজধানী ঢাকায় কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যান, তাদের কোন কবরস্থানে দাফন করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অনেকের মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে এলাকাবাসী লাশ গাড়ি থেকে মাটিতে নামাতে দেয়নি। এ জন্য ঝগড়া-বিবাদ, রাজনীতি, কুসংস্কার, ভয়ভীতিসহ নানা বিষয় হাজির করে তালগোল পাকানো হয়েছে।
সম্প্রতি লাশ দাফনে বাধা দেয়ার মতো কিছু ঘটনা সংবাদ শিরোনাম হয়ে মানুষের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে; যা অত্যন্ত অমানবিক ও মর্মান্তিক। করোনায় আক্রান্ত কি না, তা টেস্ট করার আগে নিশ্চিত হওয়ার উপায় কারও নেই। শুধু লক্ষণ দেখে করোনা বোঝা যায় না। আবার অনেকে করোনার লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন; কিন্তু টেস্ট করার পর তাদের করোনার ফল নেতিবাচক এসেছে। এ ধরনের অন্তত এক ডজন দুঃখজনক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে। এখানে যে দুটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে, তাদেরও টেস্ট করার পর ফল নেতিবাচক পাওয়া গেছে।
মতলব দক্ষিণ উপজেলার নায়ের গাঁওয়ের নাউজান গ্রামের জনৈক পাটোয়ারী শ্বাসকষ্ট ও জ্বর নিয়ে মারা গেছেন। নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তার লাশ দাফনে বাধা দিয়েছে তার নিজ গ্রামের লোকজন। হায়রে নিয়তি! এটা কি ভয়, হীনম্মন্যতা, কুসংস্কার, হিংসা, নাকি ক্ষমতার দাপট? বেঁচে থাকা মানুষগুলো একদিন যার খেলার সাথী ছিল, আপনজন ছিল, তারা আজ তাদের চিরচেনা বন্ধুর লাশকে যথাযথ মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করছে। লাশের সঙ্গে এ কেমন দুর্ব্যবহার! যে মাটিতে তার জন্ম সেই মাটি তাকে কোলে নিতে পারছে না নিষ্ঠুর মানুষগুলোর জন্য।
আরেকটি মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছে পাটগ্রাম থানার আমবাড়ি গ্রামে। যে গ্রামের এক মেয়ে টঙ্গীতে পোশাক কারখানায় কাজ করত, ঈদের ছুটিতে ট্রাকে চড়ে বাড়িতে ফেরার সময় ভোররাতে রংপুর ক্যাডেট কলেজের কাছে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর ১৬ ঘণ্টা পর অনেক লুকোচুরি শেষে তার বাবাকে খবর দেয়া হয়। এরপর পুলিশকে খবর দিলে নিয়মানুযায়ী মেডিকেল কলেজে নিয়ে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। পুলিশের সিলমারা সাদা প্লাস্টিক কভারে ভরে তার বাবাকে বুঝিয়ে দিলে বাবা লাশ নিয়ে গ্রামে চলে যান। এর পরের ঘটনা অনেক করুণ, অনেক ঘৃণার। লাশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়; কিন্তু স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রামের মধ্যে লাশ দাফনে বাধা দেন। লাশ তাদের গ্রামে নিয়ে এলে লাশবাহী গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হবে বলে ভয় দেখিয়েছেন। মেয়ের বাবা নিরুপায় হয়ে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে দাফনের জন্য লাশটি দিয়ে দেন। এ জন্য তিনি একটি লাশবাহী গাড়ির ড্রাইভারকে পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করেন; কিন্তু ওই ড্রাইভার লাশটি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর না করে গভীর রাতে রংপুরের গঙ্গাচড়া থানার দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর কাছে তিস্তা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। একজন অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার কী করে পাঁচ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে একটি ময়নাতদন্ত করা লাশকে ঠিকানায় পৌঁছে না দিয়ে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দিল? এ কি তার বিবেক?
নদীর স্রোতের টানে সেই লাশ লালমনিরহাটের আদিতমারী থানার গোবর্ধন ইউনিয়নে ভেসে এলে সেখানকার মানুষ সাদা ব্যাগে ‘বাংলাদেশ পুলিশ’ লেখা দেখে আদিতমারী থানায় খবর দেন। পুলিশ আবারও তার বাবাকে খবর দেয় এবং তিনি এসে মেয়ের লাশ শনাক্ত করেন। এরপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে আবারও গলিত লাশ তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়। পুরো বিষয়টি নিয়ে এক করুণ নাটকের সৃষ্টি করা হয়েছে; যা লেখার ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।
করোনার নিষ্ঠুরতায় মানুষের মধ্যে হতাশা বেড়েছে বহুগুণ। বিচলিত মানুষ যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষকে বোকা ও অসচেতন করছে এ অদৃশ্য জীবাণুর ভয়াবহতা। এর ফলে স্বার্থপরতা বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ ক্রমান্বয়ে নানা কুসংস্কারে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া নির্দেশনা ও বিনা পয়সার অবাধ জ্ঞান বিতরণ প্রক্রিয়া এ কুসংস্কারকে আরও বেশি উসকে দিচ্ছে।
করোনার ভয়ে মৃতদেহ দাফন বা সৎকারে আত্মীয়রা ভার্চুয়াল জানাজা পড়ছেন ঠিক আছে; কিন্তু মৃতদেহ রেলস্টেশনে, হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? চলতি পথে গাড়িতে কোনো যাত্রী মারা গেলে তাকে রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে যেতে হবে- এমন পৈশাচিক অবস্থা তৈরির জন্য করোনাকে দায়ী করা হলেও দায়ী হচ্ছে সেইসব মানুষ, যারা স্বার্থপরতার চরম অবস্থানে চলে গেছে। এমনকি মারা যায়নি অথচ করোনা হয়েছে ভেবে এক মাকেও সন্তান ও জামাই মিলে জঙ্গলে ফেলে আসার অমানবিক সংবাদ জানা গেছে।
বেহুঁশ মানুষ নিজে বাঁচার জন্য জীবন-জীবিকাকে সমার্থক ভাবতে গিয়ে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে বনের পশুর পর্যায়ে চলে গেছে। ভোগবাদী মানুষ শুধু দুনিয়ার খেয়াল নিয়ে মত্ত থাকার ফলে মৃত্যুর প্রস্তুতি কখনও নেয় না। ফলে মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে বাস্তবতা বুঝতে পেরে সবকিছুতে হুঁশ হারিয়ে ফেলে। ভোগবাদীরা জীবনটাকে ভোগ-বিলাসে মত্ত রাখায় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নির্দিষ্ট পথে অবস্থান করে না। ফলে শুধু দুনিয়ার খেয়াল তাদের অন্ধ ও বেশি স্বার্থপর করে তোলে। মৃত্যুভয় তাদের বেশি আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। নিজে বাঁচার জন্য তারা বেশি তৎপর হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ এখনও শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছায়নি। সামনে কঠিন দিন অপেক্ষা করছে বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন। সেই ভয়াবহ দিন না আসুক সেটাই আমরা কামনা করি; কিন্তু সেই দুর্দিন আসার আগেই আমরা করোনা সন্দেহে সাধারণ লাশের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার শুরু করে দিয়েছি। একজন ইউপি চেয়ারম্যান বা যে কোনো জনপ্রতিনিধি তার এলাকায় কোনো করোনা রোগীর লাশ দাফনে বাধা দেয়া বা এ ধরনের নিষ্ঠুর নিষেধাজ্ঞা বা আদেশ দিতে পারেন না।
একটি লাশ যদি একজন করোনাক্রান্ত রোগীর হয়েই থাকে, তাহলে তাকে কোনো এলাকার মাটিতে দাফন করতে বা সৎকার করতে বাধা দেয়ার যুক্তি কী? এ জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি না, তা আজও কেউ মুখ খুলে ব্যাখ্যা করছেন না। কেউ কেউ বলেছেন, মৃত ব্যক্তি থেকে করোনা সংক্রমণ ছড়ায় না। কবরে মাটিচাপা দিলে সেই লাশ থেকে জীবাণু মাটি ফেটে বের হয়ে আসার কথা নিতান্তই গুজব। এর পেছনে ধর্মীয় ও সামাজিক যুক্তি ও বিধিনিষেধ কী তা আজও মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়। তাই মানুষ অন্ধের মতো হীনম্মন্যতাবোধ থেকে এবং সঠিক বৈজ্ঞানিক কারণ না জেনে বারবার লাশ দাফনে বাধা দিচ্ছে। শুধু সন্দেহ করে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে দিলে মানুষের কষ্ট ও হতাশা আরও বেড়ে গিয়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা বাড়ে। মানুষ শান্তিতে মরতে চায়। মৃতদের আত্মীয়রা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে স্বজনের লাশ দাফন ও সৎকার করার নিশ্চয়তা চান। এ ব্যাপারে সরকারি ঘোষণা পরিষ্কারভাবে থাকা দরকার।
আসুন, করোনার এ ভয়াবহ সময়ে দুর্ভাগ্যবশত যারা আমাদের ছেড়ে আগে পরপারে চলে যাচ্ছেন, তাদের মরদেহ দাফনে বাধা না দিয়ে বরং সাধ্য অনুযায়ী সম্মান দেখাই। সব মানুষই এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চলে যাবে- কেউ আজ, কেউ বা আগামীকাল। সুতরাং শুধু সন্দেহবশত লাশ দাফন নিয়ে এত ভয় ও নিষ্ঠুরতা কেন?
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান