’৬৫-এর যুদ্ধে ভারতের কাছে চরম মূল্য দিয়ে আইয়ুব খানকে তাসখন্দ চুক্তির ভিত্তিতে রক্ষা পেতে হয়। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে পিডিএম একটি সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে। মুজিব ভাই (তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) ঐ বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার আঙ্গিকে ৬ দফার প্রস্তাবটি পেশ করেন।
আহমদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দুস, শামসুর রহমান খান (জনসন ভাই) ও রেহমান সোবহান ৬ দফা কর্মসূচিটি প্রণয়ন করে মুজিব ভাইয়ের হাতে তুলে দেন। গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানকারী সব দলই এটিকে আন্দোলনের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে অক্ষমতা প্রকাশ তো করলই, বরং তারস্বরে অপপ্রচার শুরু করল—শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচি প্রদান করে সর্বপাকিস্তানি আইয়ুব উত্খাতের আন্দোলনকে পিছিয়ে দিল।
মুজিব ভাই (তখন তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ) পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে ৬ দফাকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে অনুমোদন লাভের জন্য দলের বর্ধিত সভায় পেশ করেন। দুঃখজনক হলেও বাস্তব, ঐ বর্ধিত সভায়ও সেটা অনুমোদিত হয়নি।
এ অবস্থায় ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাককে ডেকে তাদের হাতে ৬ দফার একটি খসড়া তুলে দিয়ে মুজিব ভাই বললেন, এটি মূলত জাতির মুক্তিসনদ। আমি ছাত্রলীগের হাতে এই মুক্তিসনদ তুলে দিলাম।
সেদিন অকুতোভয়ে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব গ্রহণ না করলে ৬ দফা আঁতুড়ঘরেই মৃত্যুবরণ করত, আলোর মুখ আর দেখত না। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই কর্মসূচিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টায় ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে থাকে।
৬ দফা প্রদানের পরপরই মুজিব ভাই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ডাকেন। কাউন্সিলে ৬ দফা অনুমোদিত হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে মুজিব ভাই সভাপতি নির্বাচিত হন। তবু ৬ দফাকে বাংলার মানুষের মননশীলতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়ার মূল শক্তি ও প্রতীতির জায়গা ছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু মুজিব ভাই বাংলাদেশের প্রতিটি মহকুমা সফর করার সিদ্ধান্ত নেন; সেটিও সফল করার দায়িত্ব নেয় ছাত্রলীগ।
কয়েকটি মহকুমা শহরে সভা করার পর জেলাভিত্তিক সভা করার পরই যশোরে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। জামিন পেলে আবার খুলনায় গ্রেপ্তার করা হলো, আবার মুক্তি পেলেন। এভাবে গ্রেপ্তার ও জামিনে আলো-আঁধারের খেলা চলতে চলতে সরকার সিদ্ধান্ত নিল ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলসে তাকে কারারুদ্ধ করার, যেখানে জামিনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মুজিব ভাই ও তার সহকর্মীসহ রাজবন্দিদের মুক্তি এবং ৬ দফাকে জাতীয় কর্মসূচিতে রূপদানের আঙ্গিকে ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী পূর্ণ দিবস হরতাল আহ্বান করা হয়।
মূল নেতৃত্বের একটি অংশ ৬ দফাকে সমর্থন না করা এবং একটি অংশ কারাগারে থাকায় জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আমেনা বেগম আওয়ামী লীগকে সংগঠন হিসেবে কোনো রকমে টিকিয়ে রেখেছিলেন। ইতিমধ্যে মানিক ভাইও ৬ দফার প্রতি তার সমর্থন ও প্রতীতি ঘোষণা করেন (এই সমর্থন আদায়ে শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও সৈয়দ মাযহারুল হক বাকীর অদম্য প্রচেষ্টার সঙ্গে আমিও সম্পৃক্ত ছিলাম)।
একদিকে ইত্তেফাক, অন্যদিকে ছাত্রলীগ (তখনো আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতৃত্বের মধ্যে ৬ দফার পক্ষে প্রতীতি ও প্রত্যয়ের জন্ম হয়নি) ৭ জুনের হরতালের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতৃত্বের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খানসহ ছাত্রলীগের অসংখ্য প্রাক্তন নেতৃত্ব ৭ জুন সফল করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এসে অবস্থান নেন। তখন আমাদের সামনে ঘনঘোর অমানিশা।
এনএসএফ থেকে শুরু করে ছাত্র ইউনিয়নসহ ডান-বাম সব সংগঠনই ৬ দফাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের ঘোরতর বিরোধী। আমরা যখন বাঙালির মননশীলতার আঙ্গিকে ৬ দফার মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর, তখন ডানপন্থিরা তো বটেই, বামপন্থিরাও তারস্বরে চিত্কার করছেন, শেখ মুজিব দেশদ্রোহী, সিআইএর দালাল, ভারতের অনুচর। তার মৃত্যুদণ্ডই তাদের প্রচারণার মুখ্য বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
তখনো শ্রমিক লীগের জন্ম হয়নি। কিন্তু শ্রমিকদের এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে ৭ জুন হরতাল পালন অসম্ভব ও অবাস্তব ছিল। সর্বজনাব খালেদ মোহাম্মদ আলী, কামরুজ্জামান টুকু, ফিরোজ নূন ও আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে তেজগাঁও এলাকাকে হরতালের পক্ষে সংগঠিত করার।
তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র সংসদের সহসভাপতি রহমত উল্লাহ আমাদের সাথে যোগ দেন। আমাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ স্থানীয় প্রভাবশালী শ্রমিকনেতা রুহুল আমিন ভূইয়ার (তার বাড়ি নোয়াখালী) সমর্থন কিছুটা আদায় করতে সক্ষম হন। উনি পরোক্ষ সমর্থন দিলেও প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সঙ্গে কোনো মিটিং বা মিছিলে কখনো আসেননি।
৩ জুন তেজগাঁওয়ের একটি ময়দানে বিশাল (!) জনসমাবেশে কামরুজ্জামান টুকু সাহেব ও আমাকে পাঠানো হয় বক্তৃতা করার জন্য। যথাসময়ে পৌঁছে দেখলাম, সেখানে বিশাল তো দূরে থাক, জনাপাঁচেক লোকও উপস্থিত নেই। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, হঠাত্ একজন যুবক এসে পরিচয় দিল—‘আমার নাম শহীদুল্লাহ, আমি তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।’
আমার সমস্ত শরীর তখন রাগে, ক্ষোভে কাঁপছে। তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম চার-পাঁচ কেজি লজেন্স কিনতে হবে। পথশিশু-কিশোরদের যতটা সম্ভব জড়ো করে একটি খণ্ড মিছিল করে হলেও ৭ জুন হরতালের বিষয়টি জানান দিতে হবে। প্রথমে ১৫-২০ জন ছেলে সমবেত হলো। তার মধ্যে একটি চটপটে ছেলেকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। সে লজেন্স বিলি করবে এবং যতটা সম্ভব পথপার্শ্ব ও মহল্লার ছেলেদের মিছিলে সম্পৃক্ত করবে।
আমি আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম, তেজগাঁও স্টেশন এলাকায় যখন সভার জন্য দাঁড়ালাম, ততক্ষণে দুই-আড়াই হাজার লোক সেই মিছিলে যুক্ত হয়ে গেছে। একটা হ্যান্ডমাইকও কোথা থেকে যেন জোগাড় হয়ে গেল। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আমি প্রবল উত্তেজনা নিয়ে বক্তৃতা করলাম। সেদিনের সেই সভায় আমি নিজে কেঁদেছিলাম, উপস্থিত জাগ্রত জনতাকেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছিলাম।
৬ জুন রাতে আমরা দায়িত্ব ভাগ করে দিয়ে তেজগাঁওয়ের শ্রমিকদের মেসগুলোতে গিয়ে অনুরোধ-উপরোধ করতে থাকলাম। ৩ তারিখ থেকে ৭ তারিখ সকাল পর্যন্ত ৩০০-৪০০ লোক প্রতিশ্রুতি দিলেন তারা সর্বাত্মক সহায়তা করবেন। আমরা তখন মনু মিয়াকে চিনতাম না। ৭ জুন ভোর থেকে শত চেষ্টা করেও একটা কার্যকর মিছিল বের করা সম্ভব হয়নি। যেটুকু হয়েছিল, সেটাকে ঝটিকা মিছিল বলাই বাঞ্চনীয়। প্রকাশ্যে মিছিল করতে ব্যর্থ হয়ে আমরা কয়েক জন সিদ্ধান্ত নিলাম যে ৭ জুন সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী এক্সপ্রেস ট্রেনটির গতি রোধ করে দেব।
তখন আমার নিজের মধ্যে একটা নেশা ধরেছিল, যেকোনো উপায়ে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে। সংখ্যায় আমরা ২৫-৩০ জন হব। প্রচণ্ড আবেগে আমরা রেললাইনের ওপর শুয়ে পড়ে রেলের গতি রোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই আঙ্গিকে আমি অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্য দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে উত্তেজক বক্তৃতা করছিলাম। সেই খবর কোনোভাবে পুলিশের কাছে পৌঁছেছিল বিধায় তারা স্বতন্ত্র একটি ট্রেনের ইঞ্জিন নিয়ে ১০-১৫ জন পুলিশ পাইলটিং করে আগলে নিয়ে এগোচ্ছিল ঐ এলাকা পার করে দেওয়ার জন্য।
আমাদের কাছাকাছি এসে পুলিশভর্তি ইঞ্জিনটি থেকে একজন গুলি ছোড়ে (সেদিন নারায়ণগঞ্জ ও সদরঘাটেও গুলি হয়েছিল)। যে দুজনের ঘাড়ে ভর দিয়ে আমি বক্তৃতা করছিলাম, তাদের একজন মাটিতে পড়ে গেলেন; তিনিই মনু মিয়া। তাকে সঙ্গে সঙ্গে তেজগাঁওয়ের একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। তখনো তিনি জীবিত এবং জ্ঞান রয়েছে। বিন্দুমাত্র চিকিত্সা তার শুরু হয়নি, আমার কোলে মাথা রেখে মনু মিয়া বিড়বিড় করে বললেন, ‘মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা হলে বলবেন, আমি ৬ দফার জন্য জীবন দিয়ে গেলাম।’
তেজগাঁও রেলগেটের কাছে পুলিশ আমাদের কাছ থেকে লাশ ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ধস্তাধস্তিতে আমার শার্ট ছিঁড়ে গেছে, মনু মিয়ার রক্তে আমার শরীর ভিজে গেছে। মনু মিয়ার রক্তাক্ত গেঞ্জিটি আমি হাতছাড়া হতে দিইনি।
ঐ গেঞ্জি একটি লাঠির মাথায় বেঁধে সেটিকে উড্ডীয়মান রেখে জঙ্গি মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগোতে থাকলাম। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত, আবার মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়া লোকগুলো একত্রিত হয়ে উদ্বেলিত চিত্তে স্লোগান দিয়ে এগোতে থাকত।
মনু মিয়ার মৃত্যুর পর আশ্চর্যজনকভাবে সমগ্র তেজগাঁও এলাকায় চরম উত্তেজনা ও মারাত্মক উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। পথের পাশের দোকানগুলো ঝটপট তাদের ঝাঁপ বন্ধ করতে থাকে। মিছিল কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে দোকান লুটপাটের আশঙ্কায় নয়, সেটি আমি নিশ্চিত। কারণ আমি দেখেছি দোকান বন্ধ করে তারা সটকে পড়েনি, নীরবে নিভৃতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেনি। বরং অকুতোভয়ে দৃপ্ত পদে মিছিলে অংশ নিয়েছিল। গগনবিদারী কণ্ঠে স্লোগান দিয়ে সমগ্র মিছিলকে একটি অদ্ভুত উত্তেজনায় তারা মাতিয়ে তুলেছিল। সে দৃশ্য অবর্ণনীয়। আজকের প্রেক্ষাপটে অকল্পনীয়ও বটে।
আজকে পুলিশের গুলিতে অথবা হিংস্র পাশবিক কোনো সন্ত্রাসীর গুলিতে পিচঢালা পথে রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকলে মানুষ নির্বিকার চিত্তে হেঁটে চলে যায়। মিছিল করে বজ্রনির্ঘোষে গগনবিদারী স্লোগান দেওয়া তো দূরে থাক, কোনো রকমে আত্মরক্ষায় অথবা প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত পদে তারা যে যার মতো সটকে পড়ে। এর পেছনের বাস্তবতাটি হলো, সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের যত উষ্মা-ক্ষোভই থাকুক না কেন, বিরোধী দলের প্রতি আস্থা ও প্রতীতি তাদের নাই। কারণ আজকের প্রধান বিরোধী দল—তাদের শাসনামলের অত্যাচার-নির্যাতন-নিগ্রহ মানুষের স্মৃতিতে আজও ভাস্বর।
সে যাই হোক, পথিপার্শ্ব মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মিছিলটির কলেবর বেশ বৃদ্ধি পায়। মিছিলটি যখন শাহবাগের মোড়ে, তখন দেখি ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন তার সন্তান শাহীন রেজা নূরের হাত ধরে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে গর্বিত চিত্তে হাত নেড়ে মিছিলটিকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখে আমাদের, বিশেষ করে আমার উত্তেজনা এতই বৃদ্ধি পেল যে শাহবাগ চত্বরের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে আমি প্রচণ্ড জ্বালাময়ী ভাষণ দিতে শুরু করলাম।
ভাষণের ফাঁকে ফাঁকে স্লোগান দিচ্ছিলাম—‘মনু মিয়ার রক্তে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ’, ‘পিন্ডি না ঢাকা? ঢাকা ঢাকা’, ‘আইয়ুব না মুজিব? মুজিব মুজিব’। মিছিলটি নিয়ে যখন কার্জন হলে পৌঁছালাম, তখন দেখলাম মনি ভাই, সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান), বাকী ভাই, রাজ্জাক ভাই, সাচ্চু ভাই, শহীদুল হক মুন্সী ভাই, আসমত আলী শিকদার ভাই, বাশার ভাইসহ ছাত্রলীগের অনেক বিদায়ী জ্যেষ্ঠ নেতা আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছেন। হয়তো তারা ইতিমধ্যে আমাদের মিছিল সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন। মনু মিয়ার রক্তে ভেজা গেঞ্জি নিয়ে সেই মিছিল শুধু রাতারাতি আমাকে ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপিত করেনি, ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রেক্ষাপটে এই জীবনসায়াহ্নে এসে আজও আমি পুলকিত বোধ করি। গর্ব, আনন্দ আজও আমার সমগ্র সত্তাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়।
আমাদের জ্যেষ্ঠ নেতারা তো বটেই, জেলখানা থেকে চিরকুট পাঠিয়ে মুজিব ভাইও অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ৭ জুনের কয়েক দিন পর আমি ডিপিআর আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গেলে সৌভাগ্যক্রমে মুজিব ভাইয়ের পাশের সেলেই আমাকে রাখা হয়। প্রথম সুযোগেই মৃত্যুপথযাত্রী মনু মিয়ার কথাগুলো মুজিব ভাইকে আমি গভীর আবেগতাড়িত হূদয়ে বর্ণনা করেছিলাম। তারই বহিঃপ্রকাশ মুজিব ভাই করেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। মঞ্চে বসা অবস্থায় আমি আবার ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, মুজিব ভাই এক সন্ধ্যায় তার খাটে অর্ধশায়িত। ভাবি মোড়ায় বসে পান বানাচ্ছেন। আরেকটি মোড়ায় বঙ্গবন্ধুর শিয়রের কাছে আমি বসা। বঙ্গবন্ধু তার অতীত জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ এবং আবেগতাড়িত কিছু একটা বলছিলেন। হঠাত্ ভাবি আমাকে অপ্রস্তুত করার জন্যই বোধহয় বললেন, ‘ভাই, মনু মিয়ার মা তো একজন লেখাপড়া না জানা অতি সাধারণ মহিলা। মঞ্চে দাঁড়িয়ে আপনি মনু মিয়ার মাকে উদ্ধৃত করে অশ্রুসিক্ত নয়নে যে বয়ান করেন, ঐ পল্টন ময়দানে দর্শকদের মধ্যে তো মনু মিয়ার মা-ও থাকতে পারেন। বলা তো যায় না, যদি কখনো উনি দাঁড়িয়ে চিত্কার করে বলেন, না আমি তো কখনো আপনাকে মনু সম্পর্কে এত কথা বলিনি! আপনি কারাগারে যাওয়ার আগেও বলিনি, কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পরে তো বলিইনি। আপনি কোথা থেকে এত কথা পেলেন?’
আমি বিন্দুমাত্র হতচকিত না হয়ে অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে তার জবাবে বলেছিলাম—ভাবি, আমি এ ধরনের অবস্থার মুখোমুখি কখনোই হব না। তার কারণ, পল্টন ময়দানে আমার বক্তৃতায় মনু মিয়া সম্পর্কে আমি যা বলি, তার কোনোটাই বিন্দুমাত্র মিথ্যা নয়। মনু মিয়া মারা গেছে এটি সত্য। আমার বাঁ পাশেই সে দাঁড়ানো ছিল, সেটাও সত্য। শুধু মরণের বুলেটটা আমার বক্ষ বিদীর্ণ না করে নির্মম আঘাতে মনু মিয়াকে হত্যা করেছে।
সত্যি মনু মিয়া কোনো দিন তার মাকে আর মা বলে ডাকতে পারবে না। এই নিরেট সত্যটাকে বুকে লালন করে আমি পল্টনের জাগ্রত উদ্গত, উদ্যত, উদ্ধত কালজয়ী জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা করার সময় মনু মিয়ার মৃত্যুর ঘটনাটিকে আমার অনুভূতিপ্রবণ হূদয়ের সবটুকু আবির মাখিয়ে আমার উদ্দীপ্ত হূদয়ের স্পর্শ দিয়ে যখন তুলে ধরতাম, তখন স্মৃতির বেদনায় আমি কাঁদতাম, জনস্রোতকেও কাঁদাতাম।
আমি আমার ভাষায় মনু মিয়ার মৃত্যুর ঘটনা, মৃত্যুর পরপরই তার মায়ের সঙ্গে দেখা করার ঘটনা, প্রায় তিন বছর পর কারাগার থেকে অবমুক্ত হয়ে আবার তার মায়ের কাছে যাওয়ার ঘটনা—এসব বাস্তবতা যখন তুলে ধরতাম, তাতে মিথ্যার কোনো প্রলেপ থাকত না। শুধু সত্যের সঙ্গে আমার আবেগ-উচ্ছ্বাস এবং উদ্বেলিত হূদয়ের আবির মাখানো থাকত। আমি সেদিন মানুষকে শুধু কাঁদাইনি, কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আমাকে প্রভাবিত করেনি। আবেগ আমাকে এতটাই তাড়িত করত যে আমি পাগলপ্রায় হয়ে যেতাম। আমার সব সত্তা, চিন্তা-চেতনা, চাওয়া-পাওয়া—সবকিছু মনু মিয়ার বিদেহী আত্মার সঙ্গে আমার অজান্তেই মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। আমি বক্তৃতা করতাম না, উন্মাদের মতো আমার হূদয়ের অনুভূতি তুলে ধরতাম।
মনু মিয়ার মা আমাকে মাতৃস্নেহে জড়িয়ে ধরে যা বলত, সেটি সত্যিই তার নিজস্ব অভিব্যক্তি। সেটিকেই আমার অনুভূতির রং চড়িয়ে আমার হূদয়ের তুলি দিয়ে মনু মিয়ার মায়ের অশ্রুর অভিব্যক্তির ছবি আঁকতাম। এটি আমার হূদয় নিংড়ানো নিরেট সত্য। এখানে আমার ভাষা, আমার প্রকাশভঙ্গি সন্দেহাতীতভাবে মনু মিয়ার মায়ের অভিব্যক্তি থেকে ভিন্নতর ছিল কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল না।
পুলিশের ছোড়া যে বুলেটটি মনু মিয়ার বক্ষ বিদীর্ণ করেছে, সেই বুলেট আমার বুকেও বিঁধতে পারত। মনু মিয়ার মতো আমিও শহিদ হতে পারতাম। আমি শহিদ হলে অন্য কেউ নিজের হূদয়ের আবির মাখিয়ে অথবা চোখের জলে বুক ভাসিয়ে পল্টনের লাখ লাখ লোকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমার মতো করে বর্ণনা করত কি না, জানি না। মনু মিয়ার পরিবর্তে আমি শহিদ হলে আমার লাশ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে ঐ রূপ ধস্তাধস্তি করত কি না, তাও জানি না—যেরূপ আমরা করেছিলাম।
এখানে এই নিবন্ধে আমি একটি সত্যকেই তুলে ধরতে চাই; ঘটনাপ্রবাহ একটি, সেটিকে কে কীভাবে উপস্থাপন করবেন তা তার নিজস্ব মনন, নিজস্ব মানসিকতা, ভাষা ও আবেগের ওপর নির্ভর করে। এত বিস্তারিত না বললেও মূল ও সারকথা বললে মুজিব ভাই তো বটেই, সেই সন্ধ্যায় ভাবির চোখও ছলছল করে ওঠে। মুজিব ভাই আবেগাপ্লুত হয়ে বলে ওঠেন—‘ব্র্যাভো বয়। বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া, কিছু না মিলে তো মিলে থোড়া থোড়া।’
মুজিব ভাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে এসে রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘মনু মিয়া আমার আলমের কাছে বলে গেছে, সে ৬ দফার জন্য রক্ত দিয়ে গেছে, বাংলার মুক্তির জন্য রক্ত দিয়ে গেছে। আমি এই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়ে গেলাম—তার রক্তের সঙ্গে শেখ মুজিব কখনো বেইমানি করবে না।’
পল্টনের লাখ লাখ মানুষ তখন আমার সামনে ছিল না, কিন্তু তাদের বিশাল উপস্থিতি ছিল আমার হূদয়ের ক্যানভাসে। পাকিস্তানের যে কোনো শোষণ-বঞ্চনার বিস্তীর্ণ ঘটনার বর্ণনা দিতে গেলে আমি পাগলপ্রায় হয়ে যেতাম। এখন জীবনসায়াহ্নে এসে আবেগ অনেকটাই স্তিমিত, তবু সেদিনের সেই রক্তস্নাত স্মৃতিগুলো আজও আমার হূদয়কে আপ্লুত করে বলেই পরবর্তী সময়ে পদ ও পদবির কিছুই না পাওয়া সত্ত্বেও আমি আমার হূদয়ের গভীরে পরিতৃপ্ত ও আত্মহারা।